‘ঈদের দিনও এক কেজি গরুর মাংস কিনতে পারি নাই’

এভাবে প্রতিদিন রাতে এলাকাবাসীর নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করেন এই নৈশপ্রহরীরা। বৃহস্পতিবার দিনগত রাত ১টা ৩০ মিনিটে গাজীপুরের জয়দেব বাজার এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

বৃহস্পতিবার রাত দেড়টা। গাজীপুর নগরীর জয়দেবপুর বাসস্ট্যান্ড সড়ক ধরে কিছু দূর সামনে এগোতেই দেখা মিলল জনা পাঁচেক ব্যক্তির। তাঁদের বয়স ৩৫ থেকে ৬০ বছর। এত রাতে তাঁরা সড়কে কী করছেন, তা বুঝতে দেরি হলো না তাঁদের হাতে থাকা লাঠি, টর্চ আর বাঁশি দেখে। বোঝা গেল তাঁরা নৈশপ্রহরী। রাত জেগে এলাকাবাসীর নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করছেন।

রাস্তার দুই ধারে থাকা মার্কেট ও দোকানের সামনে বসে থাকা এই নৈশপ্রহরীরা বাঁ হাতে টর্চ আর ডান হাতে লাঠি নিয়ে চারপাশে খেয়াল রাখছিলেন। এ সময় তাঁদের সঙ্গে আলাপে উঠে আসে, বাবা হয়ে মেয়েকে নোটবই কিনে দিতে না পারার কষ্ট, সংসার খরচ মেটাতে না পেরে লেখাপড়া বন্ধ করে সন্তানকে কাজে পাঠানোর কষ্ট, ঈদের দিনেও এক কেজি গরুর মাংস কিনতে না পারার ক্ষোভসহ চাকরি হারানোর ভয়।

প্রায় ১০ বছর ধরে নৈশপ্রহরীর চাকরি করছেন খোকন চক্রবর্তী (৬০)। স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে তাঁর সংসার। থাকেন নগরের বিলাশপুর এলাকার একটি ভাড়া বাসায়। মাস শেষে যা বেতন পান তা দিয়ে সংসার চলে না। তাই বাধ্য হয়ে অষ্টম ও পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ানোর পর দুই ছেলেকে পাঠিয়েছেন কাজে। তাতে তিনজনের আয়ে কোনোরকম সংসার চলছে।

খোকন চক্রবর্তী বলেন, ‘বেতন পাই ৯ হাজার টাকা। এর মধ্যে ঘরভাড়া দিতে হয় ৬ হাজার টাকা। বাকি ৪ হাজার টাকায় নুন আনতে পান্তা ফুরোনোর অবস্থা। তাই বাধ্য হইয়াই ছেলেগুলারে কাজে দিছি। তাতে অন্তত সংসার টিকব।’ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে এই নৈশপ্রহরী বলেন, ‘ইচ্ছা থাকলেও অভাবের কারণে সন্তানগুলারে লেখাপড়া করাইতে পারলাম না। এটা একটা কষ্ট।’

খোকনের সঙ্গে কথা বলার সময় পাশেই ছিলেন মো. শের আলী নামের আরেক নৈশপ্রহরী। সন্তানদের লেখাপড়ার প্রসঙ্গ উঠতেই মুখ ম্লান হয়ে যায় তাঁর। মন খারাপ করলেন কেন—জানতে চাইলে তাঁর কপালের চিন্তার ভাঁজ গভীর হয়। বলেন, ‘সামনে মাইয়্যাডার পরীক্ষা। কী জানি একটা বই কিনা লাগত! কিন্তু আমার কাছে একটা ট্যাকা নাই। তাই বইও কিনা দিতে পারতাছি না। এক সপ্তাহ ধইরাই মাইয়াডারে ঘুরাইতাছি।’

পরিবার নিয়ে গাজীপুর নগরীর ২৭ নম্বর ওয়ার্ড এলাকায় থাকেন শের আলী। তিনি বলেন, তাঁর দুই মেয়ে। বড় মেয়ে এবার এসএসসি পরীক্ষার্থী। চাকরির বেতনে সংসার চলে না। প্রতি মাসেই ধারদেনা করতে হয়। মেয়ের বই কেনার জন্য কয়েকজনের কাছে হাত পেতেছেন। কিন্তু কারও কাছেই টাকা পাননি।

এই দুজনের সঙ্গে কথা বলার মাঝেই এগিয়ে আসেন মো. সেলিম নামের অপর এক প্রহরী। নিজে থেকেই তিনি বলেন, ‘জিনিসপত্রের যে দাম তাতে আমাগোর মতো গরিব মানুষের টিকে থাকাটা কঠিন। সবকিছুর দাম বাড়ছে। কিন্তু সেই তুলনায় আমাদের বেতন বাড়ে নাই। আমরা এতটাই গরিব যে ঈদের দিনও এক কেজি গরুর মাংস কিনতে পারি নাই। আমাদের দুঃখ দেখার কেউ নাই।’

সাধারণত বাসাবাড়ি, দোকান বা মার্কেটের নৈশপ্রহরীদের গড় বেতন ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা। এই বেতন দিয়েই কোনোরকম টেনেটুনে সংসার চলে তাঁদের। নেই কোনো ভবিষ্যৎ তহবিল বা চাকরির নিরাপত্তা। কখনো কখনো সামান্য কারণেই চাকরি চলে যায়। তবু পরিবার বা দুমুঠো আহারের কথা ভেবে রাত জাগার চাকরি করে যাচ্ছেন দিনের পর দিন।

রাত সোয়া দুইটা। এবার বিদায়ের পালা। পেছন থেকে তিন নৈশপ্রহরী ডাক দিয়ে বলেন, ‘সাবধানে যাইয়েন। অভাবের বাজারে মানুষের দয়ামায়া কম। যেকোনো সময় বিপদ হইতে পারে।’ প্রত্যুত্তরে তাঁদের ভয় করে কি না, জানতে চাইলে মুচকি হেসে তিনজনের উত্তর, ‘ভয় তো একটু হয়-ই। কিন্তু কী করমু! পরিবারের দিকে তাকাইলে আর ভয় থাকে না।’