ঈদে ফয়জুন নেসার ঘরে এবার রান্নাই হবে না সেমাই

স্বামীর মৃত্যুর পর অভাবের সংসারে আর কোরবানি দেওয়া হয়নি ফয়জুন নেসার (৬০)। তাতেও এতটুকু ভাটা পড়ত না তাঁদের ঈদ আনন্দে। প্রতি ঈদেই শহর থেকে সেমাই নিয়ে বাড়ি ফিরত তাঁর দুই ছেলে। ছেলেদের বাড়ি ফেরা আর একসঙ্গে বসে সেমাই খাওয়াই ছিল ফয়জুন নেসার ঈদ।

এবার ফয়জুন নেসার ঘরে সেমাই রান্না হবে না। সেমাই নিয়ে বাড়ি ফেরার কথা ছিল যে ছেলের, সেই ছেলেই যে বাড়ি ফেরেননি।

ফয়জুনের ছেলে মহিউদ্দিন (২৪) কাজ করতেন নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে হাসেম ফুডস লিমিটেডের কারখানায়। লাচ্ছা সেমাই বানানোর শ্রমিক ছিলেন তিনি। প্রতি ঈদেই কারখানার সেমাই নিয়ে বাড়ি ফিরতেন তিনি। ৮ জুলাইয়ের আগুনে যে ৪৯ শ্রমিকের নাম নিখোঁজের তালিকায় উঠেছে, তাঁদের মধ্যে মহিউদ্দিনও একজন। মহিউদ্দিনদের বাড়ি ভোলার চরফ্যাশনে। বাবা গোলাম হোসেনের মৃত্যুর পর মহিউদ্দিন ও তাঁর বড় ভাই সালাউদ্দিনের (২৮) আয়েই সংসার চলত।

মহিউদ্দিনের মতো সালাউদ্দিনও কাজ করেন নারায়ণগঞ্জের একটি সেমাই কারখানায়। ছোট ভাই নিখোঁজ হওয়ার পর ঢাকা ও এর আশপাশের প্রায় সব হাসপাতালেই ভাইকে খুঁজেছেন সালাউদ্দিন। তখন মা ফয়জুন নেসাকে মুঠোফোনে মিথ্যা সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিলেন মহিউদ্দিন নিরাপদেই আছেন। ঈদে বাড়ি ফেরার সময় প্রতিবারের মতো দুই ভাই একসঙ্গেই বাড়ি ফিরবেন। তবে সেই সান্ত্বনা ভোলাতে পারেনি মায়ের মন। আগুনের খবর শোনার পর থেকেই মহিউদ্দিনের জন্য পাগল প্রায় ফয়জুন। ছেলেদের বাড়ি ফেরার অপেক্ষায় পথ চেয়ে আছেন তিনি।

মঙ্গলবার মুঠোফোনে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলার সময় কান্নায় ভেঙে পড়েন সালাউদ্দিন। তিনি জানান, এত এত আহত শ্রমিকের মধ্যে ভাইকে খুঁজে পাওয়ার আশা তাঁর মনে বেঁচে ছিল। সে কারণেই মাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিলেন ঈদে বাড়ি ফেরার সময় ভাইকে নিয়ে ফিরবেন। অবশেষে ভাইকে ছাড়াই তিনি বাড়ি ফেরেন। তাঁকে দেখে ছুটে আসেন বৃদ্ধা ফয়জুন। এদিক–সেদিক খোঁজাখুঁজি করেন। মহিউদ্দিনকে খুঁজে না পেয়ে তিনি এখন পাগলপ্রায়। এখনো থেকে থেকে বাড়ির পাশের সড়কে ছুটে আসেন তিনি। সড়কে পা এলিয়ে বসেন। মহিউদ্দিনের বয়সীদের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকেন।

ফয়জুন জানেন না তাঁর ছেলে মহিউদ্দিন আর কখনো সেমাই নিয়ে বাড়ি ফিরবে কি না। সালাউদ্দিন জানেন না ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে থাকা অঙ্গার দেহগুলোর মধ্যে তাঁর আদরের ভাই আছেন কি না।

প্রতিবারের মতো এবারও বাড়ি ফেরার সময় নিজের কারখানা থেকে দেওয়া সেমাই নিয়ে বাড়ি গিয়েছিলেন সালাউদ্দিন। সেমাই দেখলেই অস্থির হয়ে ওঠেন ফয়জুন। সেমাইয়ের প্যাকেটে হাত বোলান। বৃদ্ধার চোখের জল গড়িয়ে পড়ে। সালাউদ্দিন তাই সেমাইগুলো বিলিয়ে দিয়েছেন প্রতিবেশীদের মধ্যে। সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, ঈদে তাঁদের ঘরে আর সেমাই রান্না হবে না।

মহিউদ্দিনের মতো নিখোঁজ শ্রমিকদের ঘরে ঘরে এখনো স্বজন হারানোর বিলাপ চলে। তাদের বুকে যে গভীর ক্ষত তৈরি হয়েছে, সেই ক্ষত মুছতে দুই লাখ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দিচ্ছে হাসেম ফুডসের মালিকপক্ষ। বিনিময়ে লিখিত দিতে হচ্ছে মালিকপক্ষের কাছে, তাঁদের আর কোনো দাবিদাওয়া নেই। যাঁরা একটু বেশি আশাবাদী, তাঁদের কেউ কেউ ক্ষতিপূরণের টাকা আনতে জাননি। তাঁরা অপেক্ষায় আছেন তাঁদের স্বজনেরা জীবিত অবস্থায় বাড়ি ফিরবেন। স্বজনদের জীবনের বিনিময়ে মাত্র দুই লাখ টাকার ক্ষতিপূরণ ক্ষুব্ধ করেছে অনেককেই। কেউ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, এত সহজেই এমন মৃত্যু মেনে নেবেন না তাঁরা। মলিকপক্ষের বিরুদ্ধে মামলা করবেন।

রূপগঞ্জের আগুনের ঘটনায় যে শ্রমিকেরা নিখোঁজ হয়েছেন, তাঁদের প্রায় সবাই অসচ্ছল পরিবার থেকে শহরে এসেছিলেন সচ্ছলতার আশায়। ঈদের মতো আনন্দ আয়োজনগুলোতে পরিবারের এই সদস্যদের দিকেই তাকিয়ে থাকতেন তাঁদের প্রিয়জনেরা। এসব শ্রমিকের শহর থেকে আয় করে নিয়ে যাওয়া অর্থ আরও রঙিন হতো প্রিয়জনের ঈদ। আগুন কেবল স্বজন নয়, মৃত ব্যক্তিদের পরিবারের স্বপ্ন আর ঈদের আনন্দও পুড়িয়েছে।