সিলেট-৩ (দক্ষিণ সুরমা-ফেঞ্চুগঞ্জ-বালাগঞ্জ) আসনে উপনির্বাচন ৪ সেপ্টেম্বর। করোনায় আক্রান্ত হয়ে গত ১১ মার্চ এ আসনের আওয়ামী লীগের সাংসদ মাহমুদ উস সামাদ চৌধুরী মারা যান। এরপর আসনটি শূন্য ঘোষণা করে উপনির্বাচনের দিন নির্ধারণ করা হয়। গত ২৮ জুলাই এ আসনের ভোট হওয়ার কথা ছিল। তবে করোনা পরিস্থিতিতে উচ্চ আদালতের নির্দেশে ভোটের দিন নতুন করে নির্ধারণ করে নির্বাচন কমিশন। প্রায় এক মাস পিছিয়েও এই উপনির্বাচন হওয়ায় সিলেটের ভোটের রাজনীতির চিত্র দেখতে সবার আগ্রহ রয়েছে। সিলেটে এই প্রথম শতভাগ ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোট হচ্ছে এ উপনির্বাচনে। এ নিয়েও আছে কৌতূহল। প্রতিদ্বন্দ্বী তিন প্রার্থী সম্প্রতি প্রথম আলোর মুখোমুখি হন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সিলেটে প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক উজ্জ্বল মেহেদী।
‘আমি ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী হিসেবে কোনো দাপট খাটাচ্ছি না’
—হাবিবুর রহমান, জেলা আওয়ামী লীগের কার্যকরী কমিটির সদস্য ও দলীয় প্রার্থী (নৌকা প্রতীক)
প্রশ্ন :
নির্বাচনী আসনটি আওয়ামী লীগের। এ আসনে আপনি ছাড়া মনোনয়নপ্রত্যাশী আরও ১৬ জন ছিলেন। তাঁরা কেন আপনার পক্ষে মাঠে নেই?
হাবিবুর: যাঁরা মনোনয়ন চেয়েছিলেন, তাঁরা আমার চেয়ে রাজনীতিতে সিনিয়র। আমি মনোনয়ন পাওয়ার পর থেকে তাঁদের স্নেহধন্য। নেই না, তাঁরা সবাই আছেন। আওয়ামী লীগ একটি গণতান্ত্রিক দল। বহুজন মনোনয়ন চাইবেন, মনোনয়নবঞ্চিত হবেন। তবে আমি মনে করি, তিন উপজেলার এই নির্বাচনী এলাকা পুরোটা আওয়ামী লীগের একটি পরিবার। সবাই ঐক্যবদ্ধ নৌকার পক্ষে। এখানে কোনো বিবাদ নেই।
প্রশ্ন :
ইভিএমে শতভাগ ভোট হচ্ছে। নতুন এই পদ্ধতিতে নিয়ে কিছু বলুন।
হাবিবুর: সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের স্বার্থে এটি শতভাগ কার্যকর করা হচ্ছে। ইভিএম খুব ভালো পদ্ধতি। প্রশিক্ষণে অনেক ভোটার স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নিয়েছেন। আমি মনে করি শতভাগ ইভিএম হচ্ছে বলে ইলেকশন জমজমাট হবে। এই নিয়ে কোনো আস্থা-অনাস্থা নেই।
প্রশ্ন :
ভোটের পরিবেশ কেমন?
হাবিবুর: ভোটের পরিবেশ খুবই ভালো। ব্যাপক উৎসাহ আছে। আমরা প্রার্থীরাও সহনশীল। সর্বশেষ নির্বাচনী প্রচারণায় প্রার্থীদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ হয়েছে আমার। সুষ্ঠু ভোটের জন্য আমরা আন্তরিক। আরেকটা বিষয় দেখবেন, আমি ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী হিসেবে কিন্তু কোনো দাপট খাটাচ্ছি না। প্রচারণার দিকে তাকালে বোঝা যাবে। নির্বাচনী এলাকায় প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের পোস্টার বেশি আছে। জাতীয় পার্টির লাঙ্গল আর শফি চৌধুরী সাহেবের মোটরগাড়ির পোস্টারে সয়লাব।
প্রশ্ন :
ভোটারদের ভোট দিতে কিছুটা অনাগ্রহ দেখা গেছে, এ নিয়ে আপনার দলেও উৎকণ্ঠা আছে। এ বিষয়ে কী বলবেন আপনি?
হাবিবুর: আমার মনে হয় এমনটি নেই। উপনির্বাচনে এ রকম ভোটের আমেজ-উৎসব অতীতে দেখা যায়নি। মানুষ ভোট দিতে অনাগ্রহী—এটা বিএনপির একটি ভ্রান্ত প্রচারণা। ইনশা আল্লাহ ভোটের দিন তা আবার প্রমাণ হবে।
প্রশ্ন :
জয়ী হলে প্রথম কোন কাজটি করবেন?
হাবিবুর: আমি একটি বিষয় লক্ষ করেছি, আমাদের নির্বাচনী এলাকায় দুটি প্রধান নদী সুরমা ও কুশিয়ারার তীরের এই জনপদে নদীভাঙন প্রধান সমস্যা। নদীভাঙনে যখন একটি গ্রাম বা বাড়ি বিলুপ্ত হয়ে যায়, তখন এর চেয়ে কষ্টকর আর কিছু নেই। কুশিয়ারার ভাঙন রোধে অতীতে পরিকল্পিত কোনো উন্নয়ন হয়নি। আমি কুশিয়ারার ভাঙন থেকে বালাগঞ্জ ও ফেঞ্চুগঞ্জের কিছু গ্রাম রক্ষায় পরিকল্পিত ব্যবস্থা নেওয়ার চেষ্টা করব। সেটা হবে আমার প্রথম পদক্ষেপ। এরপর একটি প্রতিশ্রুতি আছে, নির্বাচনী এলাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা।
‘এখনই দেখছি মাঠপর্যায়ে পুলিশ দাপট দেখাচ্ছে’
—আতিকুর রহমান, জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ও দলীয় প্রার্থী (লাঙ্গল প্রতীক)
প্রশ্ন :
ভোটের পরিবেশ কেমন?
আতিকুর: এত দিন ভালো ছিল। আগামী দু-এক দিন গুরুত্বপূর্ণ। তবে এই কটা দিন নিয়ে শঙ্কা আছে। এখনই দেখছি মাঠপর্যায়ে পুলিশ কিছুটা দাপট দেখাচ্ছে। পার্টির নেতা-কর্মীদের ভয় দেখানো হচ্ছে। আগ বাড়িয়ে স্থানীয় পুলিশের কিছু সদস্য এগুলো করছে। ভোটের মাঠে বিভিন্ন দায়িত্ব পালনের অজুহাতে পুলিশের বাড়াবাড়িতে নেতা-কর্মীরা কিছুটা ভয়ের মধ্যে আছেন। এ ছাড়া সার্বিক পরিবেশ ভালো।
প্রশ্ন :
শতভাগ ভোট ইভিএমে হচ্ছে। আপনার প্রতিক্রিয়া কী?
আতিকুর: ইভিএম নিয়ে আমার কোনো বিরূপ প্রতিক্রিয়া নেই। ডিজিটাল সরকারের পদক্ষেপ, আমাদের নির্বাচনী এলাকায় প্রথম শতভাগ হচ্ছে, এটা বরং আনন্দের। ইভিএমে আমার পূর্ণ আস্থা আছে। দ্রুত ভোট গ্রহণ হবে, ফলাফলও দ্রুত মিলবে। আমার নির্বাচনী প্রচারণায় ইভিএমে ভোট গ্রহণের বিষয়টি ভোটারদের মনে করিয়ে দিচ্ছি। কীভাবে ভোট দিতে হবে, সেটিও বলে দিচ্ছি।
প্রশ্ন :
উপনির্বাচনে সাধারণত ভোটার উপস্থিতি কম থাকে। এ রকম অবস্থা হবে কি?
আতিকুর: সেটা নির্ভর করে প্রার্থীদের ওপর। যদি প্রার্থী পছন্দের হন, প্রতিদ্বন্দ্বিতা জমে যায়, তাহলে সেটা বাই-ইলেকশন হলেও জমজমাট হয়। আমার মনে হয়, জমজমাট অবস্থা আছে নির্বাচনী এলাকায়। ভোটের দিন ভোটাররা কেন্দ্রে যাবেন। তবে তাঁরা সুষ্ঠুভাবে ভোট দিতে পারবেন কি না, এ টুকু নিশ্চিত হওয়া যাবে শুধু ভোটের দিন।
প্রশ্ন :
জয়ের ব্যাপারে কতটা আশাবাদী?
আতিকুর: ইনশা আল্লাহ, আমি সম্পূর্ণ আশাবাদী। বাকিটা ভোটারের হাতে। ভোটের দিন সুষ্ঠু পরিবেশ থাকলে ভোটাররা ভোটকেন্দ্রে যাবেন। ভোটাররা ভোট দিতে পারলেই আমার জয় কেউ ঠেকাতে পারবে না। ভোটের দিন কেন্দ্রের শান্তিপূর্ণ পরিবেশের জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তীক্ষ্ণ নজরদারি চাই।
প্রশ্ন :
জয়ী হলে প্রথম কোন কাজটি করবেন?
আতিকুর: যদি বিজয়ী হই, তাহলে আমি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কিছু কাজ করার পরিকল্পনা করে রেখেছি। একটি হচ্ছে নির্বাচনী এলাকার তিনটি উপজেলায় গ্যাসের সংযোগ দেওয়া। গ্যাস–সংযোগ এখন বন্ধ আছে। সিলেট থেকে গ্যাস উত্তোলন করে সিলেটকে গ্যাসবঞ্চিত রাখা, এটা অধিকারবঞ্চনা। এ নিয়ে কাজ করব। ক্ষুদ্র কলকারখানা স্থাপন করে এলাকার বেকার তরুণদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করব। আর সবচেয়ে বড় উদ্যোগ নেব খেলাধুলার প্রসারে। তিন উপজেলায় তিনটি মিনি স্টেডিয়াম করব। আপনারা জানেন, ১৯৮৬ সাল থেকে আমার নামে ফুটবল টুর্নামেন্ট প্রচলিত আছে। ফুটবল ছাড়াও ক্রিকেটকে তৃণমূলে ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা থাকবে।
‘৯৫ ভাগ মানুষ দল নয়, উন্নয়ন প্রতিশ্রুতি দেখে ভোট দেয়’
—শফি আহমদ চৌধুরী, স্বতন্ত্র প্রার্থী (মোটরগাড়ি প্রতীক)
প্রশ্ন :
আপনি তো দলবিহীন প্রার্থী। প্রতিদ্বন্দ্বীদের দল আছে, তাঁদের দলের কেন্দ্রীয় নেতারা মাঠে। আপনি একা কী করে সামলাচ্ছেন?
শফি চৌধুরী: কে বলেছে আমার দল নেই? আমার দল জনগণ। আর দল বলতে কী বোঝাচ্ছেন? কয়জন মানুষ দল করে? তা ছাড়া আমাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে কিছু উল্টাপাল্টা তথ্য দিয়ে। আমাকে খালেদা জিয়া বহিষ্কার করেননি, মহাসচিবও করেননি। চুনোপুঁটিরা বহিষ্কার করেছে। আমি যদি তাঁদের (খালেদা জিয়া-মহাসচিব) সামনে যাই, সাদরে গ্রহণ করবেন।
প্রশ্ন :
তাহলে ভোটের পর দলে ফেরার ইচ্ছে আছে কি?
শফি চৌধুরী: না। দলে আমার থাকা না থাকা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। ভোটের মাঠে দেখেছি, মাত্র ৫ ভাগ মানুষ রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জড়িত। বাকি ৯৫ ভাগ মানুষ দল নয়, উন্নয়ন প্রতিশ্রুতি দেখে ভোট দেয়।
প্রশ্ন :
আপনার উন্নয়ন প্রতিশ্রুতি কী?
শফি চৌধুরী: দেখুন, আমি এখানে নির্বাচন করছি ১৯৮৬ সাল থেকে। সেই থেকে এখন পর্যন্ত আমি শুধু এলাকার উন্নয়নই করেছি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান করেছি, গ্রামীণ রাস্তা করেছি। নারীশিক্ষার প্রসারে ব্যক্তি উদ্যোগে কাজ করেছি। এখন যেসব অবহেলিত এলাকা আছে, যেখানে কোনো উন্নয়ন হয়নি, সেখানে উন্নয়ন করব।
প্রশ্ন :
অবহেলিত এলাকা কোনটি?
শফি চৌধুরী: আমার বিবেচনায় বালাগঞ্জ হচ্ছে নির্বাচনী এলাকার সবচেয়ে অবহেলিত। সেখানে একটি জায়গায় কিছু উন্নয়ন হয়েছে। বিএনপি ক্ষমতায় থাকতে এম ইলিয়াস আলী করেছিলেন। বাকি এলাকায় কোনো উন্নয়ন নেই। নির্বাচিত হলে অবহেলিত বালাগঞ্জের উন্নয়ন করব। ফেঞ্চুগঞ্জের কিছু এলাকা আছে, সেগুলোর উন্নয়ন করব। ভোটের মাঠে নেমে মা-বোনদের কিছু বিড়ম্বনা দেখেছি, সেটি হচ্ছে গ্যাস না পাওয়ার বঞ্চনা। ঘরে ঘরে গ্যাস দেওয়ার দাবি মা-বোনদের। নির্বাচিত হলে এটি পূরণ করার সর্বাত্মক চেষ্টা থাকবে।
প্রশ্ন :
শতভাগ ইভিএমে ভোট হচ্ছে, এ নিয়ে আপনার প্রতিক্রিয়া কী?
শফি চৌধুরী: এই পদ্ধতি তো শতভাগ আগে দেখা হয়নি। সাধারণ ভোটারের মতো আমারও কৌতূহল আছে। ইভিএমে কোনো কারসাজি হয় কি না, এসব আগে বলাও ঠিক না। তবে ইভিএম ভোট দেওয়ার প্রশিক্ষণে ঘাটতি আছে। যতটা হওয়ার কথা ছিল, ঠিক ততটা হয়নি। ইভিএমে ভোট নিয়ে কেউ কেউ উল্টো চিন্তাও করছে। আগে মানুষ ভোট দিত সিল মেরে, এবার সিল নেই। পদ্ধতি পুরোপুরি বদল হয়েছে। নির্বাচন কমিশনের উচিত ছিল ব্যাপকভাবে ভোটারদের অবহিত করা। এটা করা হয়নি।