সাতসকালে গরু-মহিষের দুধ দোহনে ব্যস্ত রাখালেরা

বিস্তীর্ণ চরাঞ্চলে গবাদি পশু চরাতে নিয়ে যাচ্ছেন রাখালেরা। বুধবার বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলার দেবডাঙ্গা এলাকায় যমুনার চরেছবি: প্রথম আলো

যমুনা নদীর ধু ধু বালুচর। কোথাও কোথাও উঁচু ঢিবি। একটু দূরে তাকালেই চোখ আটকে যায় বিশাল এলাকায় গবাদিপশুর বাথানে। শুষ্ক মৌসুমে সেখানে রাখালেরা খোলা আকাশের নিচে গবাদিপশু চরান। এ অঞ্চলের খামারিদের গরু-মহিষ পালনে যমুনার চরাঞ্চল যেন এক তীর্থস্থান। সেখানকার একেকটি বাথান থেকে প্রায় ৩০০ লিটার দুধ হয়। সাতসকালে সেই গরু-মহিষের দুধ দোহনে ব্যস্ত থাকেন রাখালেরা।

বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলার যমুনা নদীর হার্ড পয়েন্ট দেবডাঙ্গা এলাকার একটি বাথানে প্রায় দেড় মাস ধরে প্রায় আড়াই শ গরু, মহিষ ও ভেড়া লালন-পালন করছেন ভুট্টা ব্যাপারী (২৮), আবদুর রশিদ (৪২), ইউনুস আলী (৩৫), ক্ষুদু ব্যাপারী (৫০), আবদুল ওয়ারেছ (২৩) ও আনোয়ারুল ইসলাম (৩৫)। এই গবাদিপশুদের চরের ঘাস ও কালাই খাওয়ানো হয়। কৃষকের কলাইয়ের খেত কিনে নেন বাথানমালিকেরা। ঘাস ও কলাই শেষ হয়ে এলে তাঁরা স্থানটি ত্যাগ করে নতুন একটি চরে এসব গরু-মহিষ নিয়ে যাবেন।

বুধবার সকালে দেবডাঙ্গার বাথানটিতে গিয়ে দেখা যায়, রোদ-বৃষ্টি থেকে বাঁচতে ধু ধু বালুচরে টিনের চালাঘর তৈরি করা হয়েছে। রাতে সেখানেই থাকেন রাখালেরা। এ সময় চালাঘরের নিচে কয়েকজন রাখালকে বসে থাকতে দেখা গেল। তাঁদের সামনে বালুচরজুড়ে বেঁধে রাখা গরু, মহিষ ও ভেড়ার পাল।

যমুনার চরে এই বাথানে ১৩-১৪ বছর ধরে গরু-মহিষ চরান ভুট্টা ব্যাপারী। সেখানে তাঁদের পরিবারের শতাধিক গরু-মহিষ আছে। আগে তাঁদের বাড়ি ছিল যমুনা নদীর চকরতিনাথ চরে। কয়েক বছর আগে চরটি বিলীন হয়ে গেলে তাঁরা পাশের চর দীঘাপাড়ায় আশ্রয় নেন। সেটাও এখন প্রায় বিলীনের পথে। নতুন করে তাঁরা হাসনাপাড়া এলাকায় বসবাস করছেন। ভুট্টা ব্যাপারীর বাবা চান্দু ব্যাপারী বয়সের ভারে ন্যুব্জ। এখন আর বাথানে থাকতে পারেন না। তাঁর তিন ছেলে আন্নু ব্যাপারী, শাহজাহান ব্যাপারী ও ভুট্টা ব্যাপারী এখন গরু-মহিষের বাথান দেখাশোনা করেন। তাঁরা প্রায় ৩০ বছর ধরে যমুনার চরে বাথান করে গরু-মহিষ লালন-পালন করে আসছেন।

বাথানে গরু–মহিষের সঙ্গে ভেড়াও লালনপালন করেন রাখালেরা। বুধবার বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলার দেবডাঙ্গা এলাকায় যমুনার চরে
ছবি: প্রথম আলো

বাথানের গরু-মহিষের তাঁরা নামও দিয়েছেন। ভুট্টা ব্যাপারী বলেন, দেখতে লাল ও চাঁদনি রাতে জন্ম হয়েছে। তাই নাম দিয়েছেন লালচান। আবার দেখতে সাদা। তাই নাম দিয়েছেন ধবলী। জন্মের সময় চোখে কালো রেখার মতো ছিল, এ জন্য নাম দিয়েছেন কাজলী। আবার বুগদা, বলাকা ও সুন্দরী নামের গরুও আছে তাঁদের বাথানে। গরুর মতো মহিষেরও নাম দিয়েছেন তাঁরা। যেমন দীপচান, হরিসিং, রামসিং, থায়াবাজ, গ্যাটামাল ও মালা নামের মহিষ আছে তাঁদের বাথানে।

ভুট্টা ব্যাপারী বলেন, বছরের কার্তিক থেকে জ্যৈষ্ঠ মাস পর্যন্ত পানি থাকে না বলে নদীর চরে গরু-মহিষ লালন-পালন করা যায়। কিন্তু সমস্যা হয় বর্ষার সময়। তখন আর উপায় থাকে না। গরু-মহিষ নিয়ে যেতে হয় তাঁদের বাড়ি হাসনাপাড়া এলাকায়। তিনি বলেন, তবে শুধু বন্যার সময় নয়, অন্য সময়ও বাথান করে গরু-মহিষ লালন-পালন করা খুবই কষ্টের কাজ। বিশেষ করে গরু অসুস্থ হলে সবচেয়ে বেশি কষ্ট হয়। সময়মতো চিকিৎসক পাওয়া যায় না।

সারিয়াকান্দি উপজেলার ৬টি ইউনিয়নে চরাঞ্চলে ৫-৭টি গরু-মহিষের বাথান আছে। প্রতিটি বাথানে ১০০-১৫০ গরু-মহিষ আছে। সেগুলো থেকে প্রায় ৭০০ লিটার দুধ উৎপাদিত হয়। এই দুধ উৎপাদনের মাধ্যমে খামারিরা দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছেন। বিশেষ করে প্রাণিজ আমিষের চাহিদার একটি বিরাট অংশ এখান থেকে পূরণ হচ্ছে।
সাইফুল ইসলাম, জেলা প্রশিক্ষণ কর্মকর্তা, বগুড়া প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তার কার্যালয়

ভুট্টা ব্যাপারী আরও বলেন, তাঁদের পরিবারে এখনো দেড় শতাধিক গরু-মহিষ চরাঞ্চলে লালন-পালন করা হয়। সেগুলো থেকে প্রায় ৩০০ লিটার দুধ হয়। দুধের দামও পাওয়া যায় ভালো। প্রতি লিটার দুধ ৭০ টাকায় বিক্রি হয়। জামালপুর জেলার বালুঝুরি এলাকার একটি দুগ্ধখামারে এ দুধ বিক্রি হয়। বছরজুড়েই খামারের লোকজন নৌকায় এসে দুধ কিনে নিয়ে যান।

গরু ও মহিষ দোহন শেষে দুধ খামারিদের ড্রামে ভরছেন রাখালেরা। বুধবার বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলার দেবডাঙ্গা এলাকায় যমুনার চরে
ছবি: প্রথম আলো

চরে ২৩টি গরু চরাচ্ছেন গাবতলী উপজেলার কালাইহাটা গ্রামের কৃষক আবদুর রশিদ। তিনি ৬-৭ বছর ধরে গাবতলী থেকে সারিয়াকান্দি উপজেলার যমুনা নদীর চরে গিয়ে পশু লালন-পালন করছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, মোটামুটি ৮ মাস চরাঞ্চলে গরু-মহিষ চরানো যায়। এতে লাভও বেশ। একদিকে দুধের টাকা ভালোই পাওয়া যায়। এই দুধ চলে যায় জামালপুরের বালুঝুরি দুধের খামারে। বাথানের প্রতি লিটার দুধ ৭০ টাকায় বিক্রি হয়। তাতে পুষে যায়।

বাথানে প্রায় ১০টি গরু চরাচ্ছেন সোনাতলা উপজেলার কলেজ স্টেশন এলাকার ইউনুস আলী। তিনি বলেন, চরাঞ্চলে গরু-মহিষ লালন-পালন করা লাভও যেমন, কষ্টও তেমন। সবচেয়ে বেশি কষ্ট হয় বর্ষাবাদলের দিনে। ভিজেপুড়ে একাকার হয়ে জীবন চলে।

আবদুল ওয়ারেছ প্রায় ১০ বছর ধরে যমুনার চরে গরু-মহিষ চরানোর কাজ করেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, চৈত্র মাসে তপ্ত দুপুরে যমুনার বালুতে পা দেওয়াই যায় না। তখন গরু-মহিষ চরাতে জীবন যেন বের হয়ে যায়। তবু জীবন-জীবিকার তাগিদে কষ্ট করেই থাকতে হয়।

গরু ও মহিষ দোহন শেষে দুধ ড্রামে ভরে নিয়ে যাচ্ছেন দুগ্ধ খামারের লোকজন। বুধবার বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলার দেবডাঙ্গা এলাকায় যমুনার চরে
ছবি: সোয়েল রানা

বগুড়া প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তার কার্যালয়ের জেলা প্রশিক্ষণ কর্মকর্তা (প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তার অতিরিক্ত দায়িত্বে) সাইফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, এই জেলা প্রাণিসম্পদে ভরপুর এলাকা। বিশেষ করে সারিয়াকান্দি উপজেলার ৬টি ইউনিয়নে চরাঞ্চলে ৫-৭টি গরু-মহিষের বাথান আছে। প্রতিটি বাথানে ১০০-১৫০ গরু-মহিষ আছে। সেগুলো থেকে প্রায় ৭০০ লিটার দুধ উৎপাদিত হয়। এই দুধ উৎপাদনের মাধ্যমে খামারিরা দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছেন। বিশেষ করে প্রাণিজ আমিষের চাহিদার একটি বিরাট অংশ এখান থেকে পূরণ হচ্ছে।