একমাত্র ছেলেকে নিয়ে বাপের বাড়িতে ঈদ করা হলো না ঝর্ণার
একমাত্র ছেলে আল আমিনকে নিয়ে বাপের বাড়ি সুনামগঞ্জের বাংলাবাজারে ঈদ করতে চেয়েছিলেন ঝর্ণা বেগম। ছোট ভাই হানিফ মিয়ার সঙ্গে ফরিদপুর থেকে সড়কপথে ভেঙে ভেঙে সুনামগঞ্জের উদ্দেশে রওনা হয়েছিলেন তিনজন। কিন্তু সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ গেল একমাত্র ছেলেসহ ঝর্ণা বেগমের।
শুক্রবার দুপুরে নরসিংদীর পলাশের চাকশাল এলাকায় কাভার্ড ভ্যান ও লেগুনার মুখোমুখি সংঘর্ষে ৬ জন নিহত হন। লেগুনার নিহত যাত্রীদের মধ্যে ঝর্ণা বেগম (৩০) ও আল আমিনও (১০) আছে। গুরুতর আহত হন ঝর্ণার ছোট ভাই হানিফ মিয়া। এই হতাহতের ঘটনায় পরিবারটিতে চলছে মাতম। এমন মৃত্যু বিশ্বাস করতে পারছেন না পরিবারটির কেউ।
নিহত ঝর্ণা বেগম কিশোরগঞ্জের হোসেনপুর উপজেলার কুঁড়িপাড়া গ্রামের সাইফুল ইসলামের স্ত্রী। পেশায় পাইকারি কাঠ ব্যবসায়ী সাইফুল ইসলাম তাঁর স্ত্রী-সন্তান নিয়ে ফরিদপুর সদর উপজেলার নয়নপুর এলাকার ভাড়া থাকতেন।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, শুক্রবার বেলা দেড়টার দিকে অন্তত ১৫ জন যাত্রী নিয়ে একটি লেগুনা পাঁচদোনার দিকে যাচ্ছিল। অন্যদিকে বিপরীত দিক থেকে একটি কাভার্ড ভ্যান টঙ্গীর দিকে যাচ্ছিল। পাঁচদোনা-ঘোড়াশাল আঞ্চলিক সড়কের চাকশাল এলাকায় পৌঁছার পর কাভার্ড ভ্যানটির সামনের চাকা ফেটে গেলে এটি নিয়ন্ত্রণ হারায়। এরপরই লেগুনাটির সঙ্গে কাভার্ড ভ্যানটির মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। লেগুনাটি দুমড়েমুচড়ে যায়। ঘটনাস্থলেই দুজন যাত্রীর মৃত্যু হয়। স্থানীয় লোকজন আহত অবস্থায় উদ্ধার করে আটজনকে নরসিংদী সদর হাসপাতালে পাঠান। হাসপাতালে নেওয়ার পথে আরও দুজনের মৃত্যু হয়। পরে হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসাধীন অবস্থায় আরও একজনের মৃত্যু হয়। এ ছাড়া মৃত অবস্থায় ঝর্ণা বেগমকে হাসপাতালে নিয়ে আসে পুলিশ।
দুর্ঘটনায় নিহত অন্য চারজন হলেন গাজীপুরের কালীগঞ্জ উপজেলার চাঁন মিয়া (৫৫), লেগুনাচালক নেত্রকোনার পূর্বধলার নোয়াগাঁও গ্রামের আমান মিয়া (২৩), রাজধানীর মিরপুরের এস এম শওকত হোসেন (৫৫) ও ৪৫ বছর বয়সী অজ্ঞাতনামা এক পুরুষ।
নিহত ঝর্ণার ছোট ভাই হানিফ মিয়া বলেন, ‘শুক্রবার সকালের দিকে ফরিদপুর সদর উপজেলার নয়নপুর থেকে আমরা তিনজন সুনামগঞ্জের বাংলাবাজারের উদ্দেশে রওনা হয়েছিলাম। রাজধানীর বিমানবন্দর পর্যন্ত বাসে করে আসি। আমাদের ইচ্ছা ছিল হয় ট্রেনে করে, না হয় সরাসরি বাসে সুনামগঞ্জ ফিরব। ট্রেন ও সরাসরি বাস না পাওয়ায় আমরা ভেঙে ভেঙেই রওনা হই। বিমানবন্দর এলাকা থেকে বাসে টঙ্গী আসি আমরা। সেখান থেকে ঘোড়াশাল পর্যন্ত আসি আরেকটি বাসে করে। পরে ঘোড়াশাল থেকে একটি লেগুনায় করে পাঁচদোনা মোড়ের দিকে যাত্রা করি। পথেই দুর্ঘটনায় আমার বড় বোন ও একমাত্র ভাগনে মারা যায়। নিজেও গুরুতর আহত হই। আমাদের পরিকল্পনা ছিল, পাঁচদোনা মোড়ে এসে কোনোভাবে ভৈরব পর্যন্ত যাব। সেখান থেকে সিলেটের বাস পাওয়া সহজ। দুর্ঘটনার কারণে জীবিত অবস্থায় বোন-ভাগনেকে নিয়ে বাড়িতে ফিরতে পারলাম না।’
হানিফ মিয়া আরও বলেন, ‘দুর্ঘটনার পর উপস্থিত লোকজনের মধ্যে কেউ কেউ আমাদের একটা মুঠোফোন, কাপড়ভর্তি দুইটা ব্যাগ ও টাকাপয়সা নিয়ে গেছে। আহত অবস্থায় আমার পা থেকে এক জোড়া জুতা পর্যন্ত খুলে নিয়ে গেছে। আমি শক্তিহীন অবস্থায় চেয়ে চেয়ে শুধু দেখেছি। মোজা জোড়া পরা অবস্থায় আমি বাড়িতে এসেছি। শুধু মোবাইলটা যদি না নিত, তাহলে স্বজনদের সঙ্গে তাৎক্ষণিক যোগাযোগ করতে পারতাম।’
নিহত ঝর্ণার পরিবার সূত্রে জানা গেছে, শনিবার সকাল ১০টার দিকে সাইফুল ইসলাম নরসিংদী সদর হাসপাতালের মর্গ থেকে তাঁর স্ত্রী ও সন্তানের লাশ গ্রহণ করেন। তিনি দুজনের লাশ নিয়ে একটি অ্যাম্বুলেন্সে করে কিশোরগঞ্জের হোসেনপুর উপজেলার কুঁড়িপাড়া গ্রামে রওনা হন। পরে বেলা আড়াইটার দিকে ওই গ্রামে জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে দুজনের লাশ দাফন করা হয়।
সাইফুল ইসলাম জানান, এবারের ঈদ একমাত্র ছেলেকে নিয়ে বাপের বাড়িতে উদ্যাপন করার খুব ইচ্ছা ছিল ঝর্ণার। বেশ কিছুদিন আগে থেকেই তারা নানা ধরনের পরিকল্পনা করে রেখেছিল। বাপের বাড়িতে ঈদের আনন্দ আর উদ্যাপন করা হলো না ঝর্ণার।
নরসিংদীর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) ইনামুল হক জানান, ওই দুর্ঘটনায় মা-ছেলেসহ নিহত ছয়জনের মধ্যে পাঁচজনের পরিচয় নিশ্চিত হতে পেরেছে পুলিশ। নিহত অন্যজনের পরিচয় শনাক্তের চেষ্টা চলছে। পরিচয় শনাক্ত না হওয়া ব্যক্তির লাশ নরসিংদী সদর হাসপাতালের মর্গে রাখা আছে।