ব্রাহ্মণবাড়িয়া
এক খালে ৪ অবৈধ সাঁকো, আছেন ৯ দখলদারও
ক্ষমতাসীন দলের এক নেতা খালের ওপর একটি সাঁকো নির্মাণ করেছেন। খালের জায়গা দখল করে বাড়িঘর বানিয়েছেন ৯ দখলদার।
সরকারের দেওয়া সাতটি সেতু থাকার পরও নিয়ম লঙ্ঘন করে শহরের প্রধান খালের ওপর কাঠ ও বাঁশের আরও চারটি সাঁকো বানিয়েছেন স্থানীয় লোকজন। এর মধ্যে আওয়ামী লীগের এক নেতা নিজের বাড়ির সামনে খালের ওপর একটি সাঁকো নির্মাণ করেছেন। এ ছাড়া খালের জায়গা দখল করে বাড়িঘর নির্মাণ ও সীমানা বাড়িয়েছেন অন্য নয়জন।
পৌরসভা সূত্রে জানা গেছে, শহরের পূর্ব দিকে তিতাস নদের সঙ্গে সংযুক্ত টানবাজার ও কান্দিপাড়া এলাকা দিয়ে খালটি শুরু হয়ে শহরের ভেতর দিয়ে গোকর্ণঘাট হয়ে আবার তিতাসের সঙ্গেই মিলিত হয়েছে। খালটির মালিক ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা পরিষদ। এটি জেলা শহরের প্রধান খাল বা টাউন খাল নামে পরিচিত। খালের দৈর্ঘ্য ৪ দশমিক ৮০ কিলোমিটার।
খালের ওপর ঘোড়াট্টি এলাকায় দুটি এবং কুমিল্লা-সিলেট মহাসড়কের পৈরতলা এলাকার সেতুটি সওজের, কান্দিপাড়ার খালপাড় এলাকায় জেলা পরিষদের একটি, মৌলভীপাড়া-কাজীপাড়া ও দক্ষিণ পৈরতলা এলাকায় পৌরসভার দুটি, গোকর্ণঘাট এলাকায় এলজিইডির একটি সেতু রয়েছে।
গত বৃহস্পতিবার ও গতকাল শনিবার সরেজমিনে দেখা গেছে, কান্দিপাড়া খালপাড় এলাকায় জেলা পরিষদের একটি সেতু রয়েছে। এই সেতুর পূর্বে ১০০-১৫০ গজ দূরে পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলামের বাড়ির সামনে খালের ওপর বাঁশ ও কাঠের অবৈধ দুটি সাঁকো করা হয়েছে। একটি আওয়ামী লীগ নেতা নিজে নির্মাণ করেছেন। অন্যটি একই এলাকার প্রভাবশালী প্রয়াত পাঠান মিয়ার জামাতা শাজাহান মিয়া তৈরি করেছেন। উত্তর ও দক্ষিণ পৈরতলার পশ্চিম দিকে খালের ওপর আরও দুটি অবৈধ বাঁশ-কাঠের সাঁকো নির্মাণ করেছেন স্থানীয় প্রভাবশালীরা।
জানতে চাইলে পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আইনি-বেআইনি নয়, জনস্বার্থের বিষয়টি মুখ্য এখানে। শিমরাইলকান্দি ও কান্দিপাড়ার মানুষ বাঁশের এই সাঁকো দিয়ে চলাচল করে। কর্তৃপক্ষ ও সরকার বাধা দিলে আমরা এসব সরিয়ে নেব।’
পৈরতলার বাচ্চু মিয়া, কাউসার মিয়া ও আলী আহমদ নামের কয়েকজন বলেন, সাঁকোটি অবৈধ ঠিক আছে। কিন্তু মানুষের চলাচলের সুবিধার্থে এটি নির্মাণ করা হয়েছে।
এদিকে জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহীর নির্দেশে ২০১৯ সালের ১০ জুলাই জেলা পরিষদের জরিপকারী বদিউল আলম ও সহযোগী জরিপকারী রজব আলী শুধু খালের পৈরতলা সেতুর পশ্চিম পাশের প্রায় আধা কিলোমিটার এলাকা পরিমাপ করেছেন। সেখানে সেতুর পশ্চিম দিকে দক্ষিণ পাশে নয়জন অবৈধ দখলদারের তালিকা করেছেন তাঁরা। জেলা পরিষদের মতে, সেখানে ৩০ জন অবৈধ দখলদার রয়েছেন।
জেলা পরিষদের তালিকা অনুসারে, দক্ষিণ পৈরতলা এলাকার শাহারা খাতুন ৩৩০ বর্গফুট, একই এলাকার জমু মিয়া ৪০০ বর্গফুট, রোমানা বেগম ৫২৫ বর্গফুট, আবদুল জলিল ১৪৪ বর্গফুট, জাহের মিয়া ১৫৪ বর্গফুট, শঙ্কর মিস্ত্রি ৮৪০ বর্গফুট, ধন মিস্ত্রি ৫৮৮ বর্গফুট, সন্তোষ বণিক ২৮০ বর্গফুট, বাচ্চু মিয়া ৩১০ বর্গফুট খালের জায়গা দখল করে রেখেছেন।
দখলদারের তালিকায় রয়েছে শাহারা খাতুন ও তাঁর ভাই আবদুল জলিলের নাম। আবদুল জলিল বলেন, ‘বাপ-দাদার আমল থেকেই আমরা এখানে বসবাস করছি। আমি ও আমার বোন শাহারা—কেউ খালের জায়গা দখল করিনি। জেলা পরিষদের তালিকা ঠিক নয়।’
শঙ্কর মিস্ত্রির ছেলে লক্ষ্মণ সূত্রধর বলেন, ‘ছয় ফুট বাদে আমাদের পুরো ভবন খালের ওপর পড়েছিল। দাগ দিয়ে যাওয়ার পরপরই প্রায় এক বছর আগে আমরা ভবন ভেঙে ফেলেছি।’ আর জমু মিয়া, বাচ্চু মিয়া ও জাহের মিয়া খালের জায়গা দখলের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
স্থানীয়রা জানান, কুমিল্লা-সিলেট মহাসড়কের পৈরতলা সেতু থেকে পূর্ব দিকের অংশে পৈরতলা, সরকারপাড়া, মৌলভীপাড়া ও কাজীপাড়া এলাকায় খালের দুই পাশে বসবাসকারী একাধিক পরিবার খালের জায়গা দখল করে রেখেছে। তারা বাড়ির সীমানা বাড়িয়ে খালের পাড় দখল করেছে। উত্তর পৈরতলা এলাকায় খালের একাধিক অংশ দখল হয়ে আছে। এতে খালটি সংকুচিত হয়ে গেছে।
জেলা পরিষদের প্রশাসনিক কর্মকর্তা রতিশ চন্দ্র রায় ও সহযোগী জরিপকারী রজব আলী প্রথম আলোকে বলেন, ‘দক্ষিণ পৈরতলা এলাকায় নয়জন দখলদারের তালিকা করেছি। করোনা আর বিধিনিষেধের পর আবার খালের সীমানা নির্ধারণ করা হবে। দখলদারদের জায়গা ছাড়ার জন্য বলেছি।’
ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌরসভার মেয়র নায়েক কবির প্রথম আলোকে বলেন, বিষয়টি তাঁর জানা নেই। কান্দিপাড়া ও পৈরতলা এলাকায় তাঁরা হয়তো নিজেদের চলাচলের সুবিধার জন্য এমনটি করেছেন। তবে তাঁরা এটি করতে পারেন না। রোববার (আজ) দুই জায়গায় পরিদর্শন সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দেন তিনি।
জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শফিকুল আলম বলেন, ‘রাজনৈতিকসহ অনেক কারণে অনেক কিছু করতে পারছি না। যে যেভাবে পারছে, দখল করছে। তবে যেভাবে সুন্দর হয়, আমরা উচ্ছেদে কাজ করব।’