এক সকালে খুলনার পার্কে

ভোরের আলো ফোটার আগ থেকেই খুলনা শহরের শহীদ হাদিস পার্ক, সার্কিট হাউস, কোর্ট এলাকায় দলে দলে মানুষ হাঁটতে বের হন
ছবি: প্রথম আলো

রোজার শুরু থেকে প্রতিদিনের জীবনযাত্রার রুটিন বদলে গেছে। ভোরের খুলনা শহরে গলি থেকে রাজপথ, প্রায় যান আর জনতাশূন্য অবস্থা। ভোরের আলো ফোটার আগ থেকে শুরু হওয়া শহরের শহীদ হাদিস পার্ক, সার্কিট হাউস, কোর্ট এলাকায় দলে দলে মানুষের হাঁটাহাঁটিও কমেছে। তারপরও সুস্থ থাকার প্রত্যয়ে বৃহস্পতিবার রাস্তায় বের হওয়া মানুষের সংখ্যাটা নেহাত কম না।

ছোট ছোট দলে হাঁটছে মানুষ। কেউবা একা। নারীরাও হাঁটছেন নিজেদের মতো করে। পঞ্চাশোর্ধ্ব মানুষের পাল্লাটা ভারী হলেও তরুণেরাও আছেন এই হাঁটার দলে।

শহরে কেডি ঘোষ রোডের সঙ্গে মঞ্জুরুল ইমাম সড়কের মিলন স্থানকে কোর্টের মোড় নামে সবাই চেনে। মোড় থেকে চারদিকে চারটা রাস্তা চলে গেছে। সেখান থেকে কয়েক গজ দূরে জেলা প্রশাসন ভবনের দিকে যাওয়া সড়কের পাশের ফুটপাতে একটি চেয়ারে বসে আছেন মো. আক্তারুজ্জামান। বয়স ৫৬। সামনে ছোট একটা ভাঁজ করা টেবিল। টেবিলের দুই পাশে দুটি বসার টুল। পায়ের কাছে একটা ওজন মাপার যন্ত্র। টেবিলের ওপর রাখা আছে হ্যান্ড স্যানিটাইজার, ডায়াবেটিস মাপার যন্ত্র, উচ্চ রক্তচাপ মাপার যন্ত্র, ডায়াবেটিস পরীক্ষার কিট, তুলা, খাতা, কলম এসব।

আক্তারুজ্জামানের সঙ্গে কথা বলা শুরু করার আগেই একজন এসে টুলে বসে পড়লেন। ডায়াবেটিস পরীক্ষা, রক্তচাপ পরীক্ষা শেষে ওজন মাপালেন। ডায়াবেটিসের মাত্রা ১০ মিলিমোল। মুখে তাঁর স্বস্তি। এরপর দুজন গল্প শুরু করলেন। সেই গল্পের ফাঁকে কথা হলো ওই ব্যক্তির সঙ্গে। নাম আসলাম হোসেন (৬০)। ব্যবসার পাশাপাশি খুলনা মহানগর রিকশাভ্যান শ্রমিক লীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। বাড়ি শহরের টুটপাড়ার জাকারিয়া রোডে। আসলাম হোসেন চার বছর ধরে এখানে নিয়মিত আসেন, পরীক্ষা করান।

আসলাম হোসেন বলেন, ‘মাসে চারবার ডায়াবেটিস পরীক্ষা করাই এখান থেকে। যাঁদের ডায়াবেটিস আছে, তাঁদের খালি পেটে প্রথম মাপতে হয়। এর জন্য কোনো ল্যাবে যদি যাওয়া হয়, তবে সকাল ৯টা–১০টার আগে খোলে না। ততক্ষণ না খেয়ে থাকতে হয়। আবার সেখানে টাকাও বেশি লাগে। ফজরের নামাজ শেষে এলাকায় হাঁটাহাঁটি করি। যেদিন পরীক্ষা করাই, যেদিন হাঁটতে হাঁটতে এদিকে আসি। আজ ডায়াবেটিস ১০ এসেছে। আমার বয়স ও ওজন অনুসারে এটা তেমন ভয়ের কিছু না।’ কিছু সময় গল্প করার পর ৩০ টাকা দিয়ে বিদায় নেন আসলাম হোসেন।

আলাপে আলাপে জানা গেল, আক্তারুজ্জামানের গ্রামের বাড়ি নড়াইলের কালিয়া উপজেলার পিরুলি গ্রামে। ৩২ বছর ধরে খুলনায় আছেন। এখন থাকছেন শামসুর রহমান রোডে। পরিবারে সদস্য তিনজন। একমাত্র মেয়ে নগরের আজম খান কমার্স কলেজের বিবিএর শিক্ষার্থী। প্যাথলজি টেকনিশিয়ান হিসেবে শহরের বিভিন্ন ল্যাবে ১৮ বছর চাকরি করেছেন। নামকরা একটি ওষুধ কোম্পানিতে ভ্যাকসিনেটর হিসেবেও কাজ করেছেন। সেই কোম্পানি এখন বন্ধ হয়ে গেছে। সাত বছর ধরে পেশা হিসেবে এই কাজকেই বেছে নিয়েছেনি তিনি। প্রতিদিন একই জায়গায় বসেন। ভোরবেলা আসেন। রোদ চড়া হওয়ার আগপর্যন্ত মোড়ের কাছেই থাকেন। রোদ চড়লে কিছুটা সামনে রাস্তার উল্টো পাশে স্টেডিয়ামের নিচে চলে যান। দুপুর ১২টার পর সব বন্ধ করে বাসায় চলে যান। পরের দিন আবার একই রুটিন।

আক্তারুজ্জামান বলেন, এখানে সবাই প্রায় পরিচিত হয়ে গেছে। কেউ সপ্তাহে একবার পরীক্ষা করান। কেউ প্রতিদিন, কেউবা এক দিন পরপর পরীক্ষা করান। ডায়াবেটিস পরীক্ষা ৩০ টাকা, রক্তচাপ মাপা ১০ টাকা আর ওজন মাপার জন্য ৫ টাকা করে নেন। তবে সবকিছু একবারে করালে প্যাকেজ হিসেবে ৩০ টাকা।

প্রতিদিন কেমন মানুষ পরীক্ষা করান জানতে চাইলে আক্তারুজ্জামান বলেন, গতকাল মাত্র ১১ জন হয়েছিল। আজ এখন পর্যন্ত তিন-চারজন হয়েছে। রমজানের আগে প্রতিদিন ২৫–৩০ জন করে হতো। রোজার সময় মানুষ সকালে কম বের হয়। যারা এখন হাঁটছেন, বেশির ভাগই অমুসলিম লোকজন। আবার অনেকে রোজার সময় পরীক্ষার জন্য সুচ ফোটাতে চান না। শুধু প্রেশার মাপেন।

মো. আক্তারুজ্জামান টাকার বিনিময়ে হাঁটতে আসা মানুষের ডায়াবেটিস ও রক্তচাপ পরীক্ষা, ওজন মাপার কাজ করেন
ছবি: প্রথম আলো

এদিকে একটু বেলা বাড়ার পর থেকে লোকজনের আনাগোনা বাড়তে থাকে। হাঁটা লোকের দলও আগের চেয়ে ভারী হতে থাকে। হাদিস পার্ক এলাকায় কথা হয় একটি বেসরকারি ব্যাংকের কর্মী রাজীব সরকারের সঙ্গে। তিনি বলেন, লোকজন এখন অনেক স্বাস্থ্যসচেতন। এই পার্কে পাঁচ-ছয়টি হেলথ ক্লাবের লোক নিয়মিত হাঁটেন। ব্যায়াম করেন। ভিড়ে মাঝেমধ্যে হাঁটা যায় না। রোজার সময় সাহ্‌রির পর মানুষ একটু ঘুমায়। এ জন্য এখন হাঁটার লোক কিছুটা কম।

কয়েকটা হাঁটা দলের কথোপকথনে শোনা গেল দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ আর শ্রীলঙ্কার বাজে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে নানা জনের নানা মত।