টানাপোড়েনের পরিবার। সংসারে অভাব-অনটন নিত্যসঙ্গী থাকলেও স্বপ্নের পরিধি কখনো ছোট ছিল না। পরিবারের সবাই স্বপ্ন দেখতেন আমি চিকিৎসক হব। আমিও একের পর এক প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকের গণ্ডি পেরিয়ে স্বপ্নের পথে হেঁটেছি। একসময় সেই স্বপ্ন ধরাও দিয়েছে। আর এটা কেবলই সম্ভব হয়েছে আমার সংগ্রামী বাবার জন্য। এমন বাবা আছেন বলেই আজ আমি চিকিৎসক হওয়ার প্রথম ধাপ পেরিয়ে যেতে পেরেছি।
মা-বাবা, ভাই আর দুই বোনের সংসার আমাদের। ভ্যান চালিয়েই বাবা আমাদের সংসারের চাকা সচল রেখেছেন। মা একজন গৃহিণী। কাজের ফাঁকে কাঁথা সেলাই করে বাড়তি আয় করেন তিনি। যা পান, সবটুকুই খরচ করেন আমাদের পেছনে। আর্থিক অনটনের কারণে অষ্টম শ্রেণিতেই বড় বোনকে বিয়ে দিতে বাধ্য হন মা-বাবা। কিন্তু সেই আক্ষেপ তাঁদের আজও রয়ে গেছে। সেই আক্ষেপ থেকেই মা-বাবা তিন ভাই-বোনের পড়ালেখা চালিয়ে নিতে সংগ্রাম করে যাচ্ছেন।
এক টুকরা বসতভিটা আর ২৫ শতক জমিই সম্বল ছিল আমাদের। বড় ভাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেলে পাঁচ শতক বিক্রি করে দেন বাবা। আর লেখাপড়ার খরচ দিতে গিয়ে বাকি জমিটুকুও একসময় শেষ হয়ে যায়। ভাই এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী। আমি এ বছর অনুষ্ঠিত মেডিকেল কলেজের ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে পড়ার সুযোগ পেয়েছি। ছোট বোন স্থানীয় সমির উদ্দিন স্মৃতি মহাবিদ্যালয়ে উচ্চমাধ্যমিকে পড়ছে।
অভাব-অনটনের সংসারে বড় কোনো আবদার করতে পারিনি। দিন আনি দিন খাই, এমন একটি পরিবারে তিন ভাই-বোনের পড়ালেখার খরচ জোগানো সহজ ছিল না। কিন্তু বাবা কোনো দিন আমাদের কোনো কিছুর অভাব বুঝতে দেননি। কিছুটা বিলম্ব হলেও আমাদের চাহিদা পূরণ করে গেছেন হাসিমুখে। শত কষ্ট হলেও হাসিমুখে কষ্ট আড়াল করেন। লেখাপড়ায় ক্ষতি হবে ভেবে বাবা আমাকে লেখাপড়ার পাশাপাশি অন্য কিছু করতে দেননি। ভ্যান চালানোর আয়েই মাসের পর মাস লেখাপড়ার খরচ জুগিয়ে গেছেন। আমি সব সময় এটাই ভাবতাম, মা–বাবার কষ্ট দূর করতে হলে আমাকে অবশ্যই ভালো ফল করতে হবে। সেই ভাবনা থেকেই চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকি।
অসচ্ছলতার কথা জেনে আমার পাশে দাঁড়ান স্কুল–কলেজের শিক্ষকেরা। টিউশন ফি মওকুফের পাশাপাশি দিয়ে গেছেন প্রেরণা। এতে আমার লেখাপড়া চালিয়ে নেওয়া সহজ হয়েছে। এর জন্য তাঁদের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। বন্ধুবান্ধব-সহপাঠীরাও আমাকে সব সময় উৎসাহ দিয়ে গেছেন। তাঁরা সব সময় বলতেন, ‘আলপনা তুমি পারবে।’ আজ আমি পেরেছি। আর পেরেছি বলেই অনেকে আমার পাশে দাঁড়িয়েছেন। অনেকেই দিচ্ছেন আশ্বাস। তাঁদের আমি বলেছি, আমার বাবা যখন আছেন, তখন লেখাপড়ার খরচ নিয়ে ভাবছি না। বাবার প্রতি আমার আস্থা আছে। তিনি ঠিকই ব্যবস্থা করে নেবেন। আমার বাবা ভ্যানচালক, এতে আমার বিন্দুমাত্র লজ্জা নেই। বরং আমার পরিবার নিয়ে আমি গর্ব করি।
আমি শুধুই একজন চিকিৎসক হতে চাই না, হতে চাই একজন মানুষ। বলতে পারেন ভালো মানুষ। লেখাপড়া শেষে দুস্থ-অসহায় মানুষের জন্য কিছু একটা করতে চাই। অর্থাভাবে চিকিৎসা থেকে বঞ্চিতদের সহায় হয়ে দাঁড়াতে চাই। বিশেষ করে আমার এলাকার দুস্থ-অসহায় মানুষের জন্য প্রতিষ্ঠিত করতে চাই একটি হাসপাতাল। যেখানে দুস্থ-অসহায় মানুষ বিনা খরচে স্বাস্থ্যসেবা পাবেন। বলতে পারেন, এটাই আমার স্বপ্ন। এটা করতে পারলে জীবনে আর কিছুই চাই না।
সফলতার পেছনে কিছু বিষয় আমি খুব বিশ্বাস করি, সৃষ্টিকর্তার কাছে একাগ্রচিত্তে প্রার্থনা এবং মা-বাবা ও স্বজনদের মানসিক সমর্থন; জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণ করে, তা অর্জনে সুষ্ঠু পরিকল্পনা করা আর পরিকল্পনা বাস্তবায়নে তা ধরে এগিয়ে যাওয়া। কত ঘণ্টা পড়ব তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো এক দিনে বা সপ্তাহে নির্দিষ্ট লক্ষ্যের কতটুকু অর্জন করব। আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি, একটি লক্ষ্য নিয়ে একাগ্রচিত্তে এগিয়ে গেলে সফলতা ধরা দেবেই।