কক্সবাজার সদর মডেল থানা থেকে ছয় কিলোমিটার দূরে (দক্ষিণে) বৌদ্ধমন্দির সড়কের শতবর্ষী কেন্দ্রীয় বৌদ্ধবিহার ‘মহাসিন্দ্রোগী ক্যাং’। এই বিহারের ভেতরে ১৯৯৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘উ কোসল্লা বিদ্যা বিহার’ নামের একটি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এই বিদ্যালয় এখন মাদকসেবীদের আখড়ায় পরিণত হয়েছে।
বিদ্যালয় প্রাঙ্গণ ও শ্রেণিকক্ষে দিনরাত সমানতালে কিশোর গ্যাং এবং বখাটেদের আড্ডা, মাদক সেবন ও কেনাবেচা চলে বলে অভিযোগ উঠেছে। সর্বশেষ ১৬ আগস্ট সকালে ইয়াবার টাকা ভাগাভাগি নিয়ে সন্ত্রাসীদের মধ্যে মারামারি ও ছুরিকাঘাতের ঘটনায় নিহত হয়েছেন মো. সাজেন (৩০) নামের এক যুবক। তিনি পৌরসভার ১১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নুর মোহাম্মদের ছেলে।
পৌর শহরে একটি বিদ্যালয়ে দিনরাত সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, কিশোর গ্যাং ও বখাটের আড্ডা, মাদক সেবন এবং মাদক বেচাকেনার ঘটনায় উদ্বিগ্ন এলাকার মানুষ। বিদ্যালয়পড়ুয়া দুই শতাধিক শিশুশিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তায় অভিভাবকেরা। দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে বিদ্যালয়কে ঘিরে মাদকের জমজমাট আসর চললেও বিষয়টি ছিল পুলিশের অজানা। এখন কিশোর গ্যাং ও সন্ত্রাসীদের ধরতে মাঠে নেমেছে পুলিশ। ২০ আগস্ট রাতে শহরের টেকপাড়ায় অভিযান চালিয়ে পুলিশ গ্রেপ্তার করে সাগর বাদশা নামের কিশোর গ্যাংয়ের শীর্ষ এক সন্ত্রাসীকে। যার বিরুদ্ধে থানায় অস্ত্র, মাদক, ছিনতাইসহ সাতটি মামলা আছে।
পুলিশ সূত্র জানায়, শহরের বিভিন্ন এলাকায় এখন কিশোর গ্যাংয়ের অন্তত ১২টি দল আছে। এসব দলের সদস্যসংখ্যা প্রায় ২৮০। বেশির ভাগ সদস্য ইয়াবা, মাদক সেবন, মাদকদ্রব্য বিক্রি, চুরি ও ছিনতাইয়ের ঘটনায় জড়িত। বিভিন্ন দলের শতাধিক সদস্য দিনে ও রাতের কোনো একসময় ওই বিদ্যালয়ে গিয়ে মাদক সেবন ও বিক্রির কর্মকাণ্ড চালায়।
জেলা গোয়েন্দা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ আলী প্রথম আলোকে বলেন, ইতিমধ্যে তারা শহরের বিভিন্ন আস্তানায় অভিযান চালিয়ে কিশোর গ্যাংয়ের ২০ জন সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছেন। অন্য সদস্যদের ধরতে অভিযান চালানো হচ্ছে।
শ্রেণিকক্ষে দিনরাত মাদকের আসর, কেনাবেচা
শিক্ষক-কর্মচারীরা যখন স্কুলে থাকেন না, ভাঙা জানালা দিয়ে বিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষে ঢুকে চলে বখাটে ছেলেদের মাদক সেবন ও মাদক কেনাবেচা।
১৯ আগস্ট দুপুরে বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, বেশ কয়েকটি শ্রেণিকক্ষের লোহার জানালা ভাঙা। শিশুদের পাঠদানের শ্রেণিকক্ষে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে আছে মাদক গ্রহণের সুই-সিরিঞ্জসহ নানা সরঞ্জাম। বিদ্যালয়ের আশপাশে বেশ কয়েকজন কিশোরকে দেখা গেছে ঘুরঘুর করতে, যারা শ্রেণিকক্ষে ঢোকার সুযোগ খুঁজছিল।
বিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মচারীরা বললেন, করোনা মহামারি শুরুর পর থেকে বিদ্যালয়ে পাঠদান বন্ধ হয়। এ সুযোগে বখাটেরা বিদ্যালয়ের লোহার জানালা কেটে ভেতরে ঢুকে মাদক সেবন শুরু করে। তবে করোনা পরিস্থিতির আগেও বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে মাদকাসক্তদের আড্ডা ও মাদক সেবন চলত। এখানে মাদকাসক্ত কিশোর-তরুণদের হাতে থাকে ধারালো ছুরি ও আগ্নেয়াস্ত্র। বিদ্যালয়ে ঢোকার সময় বাধা দিলে প্রাণনাশের হুমকি আসে।
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কামাল উদ্দিন বলেন, এখন তাঁরা আটজন শিক্ষক ও দুজন কর্মচারী সকাল ১০টায় স্কুলে যান এবং দুপুর ১২টার দিকে বাড়ি ফেরেন। এ সময়টুকুতে মাদক সেবন বন্ধ থাকে। কিন্তু শিক্ষক-কর্মচারীরা যখন স্কুলে থাকেন না, ভাঙা জানালা দিয়ে বিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষে ঢুকে চলে বখাটে ছেলেদের মাদক সেবন ও মাদক কেনাবেচা। এ নিয়ে প্রায়ই মারামারি ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। কিন্তু ভয়ে কেউ প্রতিবাদ করার সাহস পায় না। বেশ কয়েকবার ভেঙে ফেলা লোহার জানালা সংস্কার করা হয়েছিল, কিন্তু রাতের বেলা তা আবার কেটে ফেলে বখাটেরা।
কিশোর গ্যাংয়ের অন্তত অর্ধশত সদস্যের নেতৃত্ব দেন বৈদ্যঘোনা এলাকার সন্ত্রাসী আবু তাহের ও তাঁর সহযোগী নাছির উদ্দিন। আবু তাহের পুলিশ কনস্টেবল পারভেজ হত্যা মামলার পলাতক আসামি। কয়েক বছর আগে শহরের জাম্বুর দোকান এলাকায় ছিনতাইকারীদের ছুরিকাঘাতে নিহত হন ওই পুলিশ সদস্য।
গত দুই বছরে বখাটেরা বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের খেলাধুলার সরঞ্জাম, হারমোনিয়াম, অফিসের আসবাবসহ মূল্যবান জিনিস ও কাগজপত্র চুরি করে নিয়ে গেছে বলে জানান প্রধান শিক্ষক। তিনি আরও বলেন, এসব ঘটনায় এ পর্যন্ত থানায় জিডি কিংবা মামলা হয়নি। কারণ, ভয় ও শঙ্কা। শহরের ভেতরে একটি বিদ্যালয়ে প্রকাশ্যে মাদকের আসর জমানোর খবরটি এত দিন পুলিশকেও জানানো হয়নি।
এদিকে সন্ত্রাসীদের ছুরিকাঘাতে মো. সেজান খুন হওয়ার ঘটনায় ১৬ আগস্ট সেজানের মা বাদী হয়ে কক্সবাজার সদর মডেল থানায় মামলা করেন। মামলায় সন্ত্রাসী আবু তাহেরসহ সাতজনের নামে হত্যা মামলা করেন।
মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শেখ মুনীর উল গীয়াস প্রথম আলোকে বলেন, ইতিমধ্যে অভিযান চালিয়ে হত্যাকাণ্ডে জড়িত সন্ত্রাসী খোরশেদ ও নাছির উদ্দীন নামে দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, এত দিন ধরে ওই বিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষে মাদক সেবন ও কেনাবেচার খবর পুলিশকে জানানো হয়নি। সেজান হত্যাকাণ্ডের পর এসব বিষয়ে পুলিশের নজরে আসে। এখন কিশোর গ্যাং ও সন্ত্রাসীদের ধরতে অভিযান চালাচ্ছে পুলিশ।
সন্তানদের নিয়ে শঙ্কায় অভিভাবকেরা
পুলিশ ও স্থানীয় ব্যক্তিদের ভাষ্য, কিশোর গ্যাংয়ের অন্তত অর্ধশত সদস্যের নেতৃত্ব দেন বৈদ্যঘোনা এলাকার সন্ত্রাসী আবু তাহের ও তাঁর সহযোগী নাছির উদ্দিন। আবু তাহের পুলিশ কনস্টেবল পারভেজ হত্যা মামলার পলাতক আসামি। কয়েক বছর আগে শহরের জাম্বুর দোকান এলাকায় ছিনতাইকারীদের ছুরিকাঘাতে নিহত হন ওই পুলিশ সদস্য। এ ছাড়া শহরের ঘোনারপাড়ার অভিক, জাদিপাহাড় এলাকার শাহীন, রাজু, বৈদ্যঘোনা এলাকার তারেকসহ কিশোর গ্যাংয়ের অন্তত ৪০ জন সদস্য স্কুল প্রাঙ্গণে দিনরাত মাদক সেবনে জড়িত।
স্থানীয় বাসিন্দা ও ছাত্রলীগ নেতা নাজমুল হোসাইন শাকিল বলেন, মাদক সেবনকারীদের অধিকাংশই কিশোর ও উঠতি বয়সী তরুণ। তারা বিভিন্ন বাসাবাড়িতে চুরি ও শহরে আসা লোকজনের কাছ থেকে মূল্যবান জিনিস ছিনতাই করে এখানে এসে ভাগ-বাঁটোয়ারা করে।
বৈদ্যঘোনা এলাকার একজন ব্যবসায়ী বলেন, তাঁর এক মেয়ে ওই স্কুলের পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর আগামী সেপ্টেম্বর মাসে স্কুলটি খোলার কথা শোনা যাচ্ছে। কিন্তু মেয়েকে স্কুলে পাঠাতে ভয় পাচ্ছেন।
বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি লাইক্য রাখাইন বলেন, ইয়াবা আসক্তদের কারণে বিদ্যালয়টি শিক্ষার পরিবেশ হারিয়েছে। বিদ্যালয়ে পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের ৪০ শতাংশ রাখাইন ও ৩০ শতাংশ হিন্দু সম্প্রদায়ের। শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা নিয়ে উদ্বিগ্ন অভিভাবকেরা।