কমিউনিটি ক্লিনিকের পর ইউপি ভবনও পদ্মায় বিলীন
মাদারীপুরের শিবচরে পদ্মার ভাঙনে একের পর এক বিলীন হয়ে যাচ্ছে স্থাপনা। গত দুই দিনের ভাঙনে পুরোপুরি বিলীন হয়ে গেল বন্দরখোলা ইউনিয়নের দুটি উল্লেখযোগ্য স্থাপনা। সোমবার সকালে পদ্মার গর্ভে চলে গেছে বন্দরখোলা ইউনিয়ন পরিষদ কমপ্লেক্সের দোতলা ভবন। এর এক দিন আগে পদ্মায় বিলীন হয়েছে একই এলাকার একটি কমিউনিটি ক্লিনিকের একতলা ভবন।
পদ্মার ভাঙনপ্রবণতা বেশি থাকায় এখন বন্দরখোলা ইউনিয়নের মানচিত্র বদলে যাচ্ছে। প্রতিবছর পদ্মার ভাঙনে শিবচরে হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ নদীগর্ভে বিলীন হচ্ছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড জিও ব্যাগের ডাম্পিং করে ভাঙনরোধের চেষ্টা করলেও আশানুরূপ ফল পাওয়া যাচ্ছে না। তাই ভাঙনের ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোয় দ্রুত স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের দাবি জানিয়েছেন স্থানীয় লোকজন।
স্থানীয় সরকার বিভাগের সূত্র জানায়, ২০০৯-১০ অর্থবছরে স্থানীয় সরকার প্রকৌশলী অধিদপ্তরের অধীনে ৬১ লাখ ৫০ হাজার টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হয় বন্দরখোলা ইউনিয়ন পরিষদ কমপ্লেক্স ভবন। এ সময় প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে ছিল পদ্মা নদী। ভবনটি ২০১২ সালের ২৭ জানুয়ারি উদ্বোধন করা হয়। নির্মাণের আট বছরের মাথায় স্থাপনাটি পদ্মার ভাঙনে বিলীন হয়েছে।
বন্দরখোলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নিজামউদ্দিন ব্যাপারী বলেন, খুব দ্রুত ভবনটি নদীতে বিলীন হওয়ায় গুরুত্বপূর্ণ কাগজ, চেয়ার-টেবিল ছাড়া অন্য কিছু নিরাপদে সরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি। সাধারণ মানুষের সেবা ঠিক রাখতে পরিষদের কার্যক্রম কাচারীকান্দি এলাকায় একটি টিনশেড ঘরে অস্থায়ী ভিত্তিতে পরিচালনা করা হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, ‘এ বছর আমার ইউনিয়নে একটি কমিউনিটি ক্লিনিক, একটি মাধ্যমিক ও একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় পদ্মায় বিলীন হয়েছে। চরের অনেক শিক্ষার্থী এই বিদ্যালয় দুটিতে পড়ালেখা করত। স্কুল দুটি বিলীন হওয়ায় এলাকাবাসীর মধ্যে খুব হতাশা কাজ করছে।’
চলতি বছর শিবচর উপজেলায় নদীভাঙনে ৭৩৮ কোটি ৫৫ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। এর মধ্যে ৩ হাজার ৩৩০টি পাকা ও আংশিক পাকা ঘর, ১৩ হাজার ৯৫০টি আধা পাকা ঘর ও ৬১ হাজার ৫৭৯টি কাঁচা ঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, কাজীরসুরা গ্রামটি পদ্মার ভাঙনে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। রোজই নদীর ভাঙন সামনের দিকে এগিয়ে চলেছে। ইউনিয়ন পরিষদের ভবনটির অর্ধেক অংশ ভেঙে পদ্মায় চলে গেছে। স্থানীয় লোকজন ভেঙে পড়া ভবন থেকে রড ও ইট সংগ্রহ করছেন। অনেকেই ভেঙে পড়া ভবনটি শেষবারের মতো দেখতে নদীর তীরে ভিড় করেছেন। পদ্মার ভয়াবহ ভাঙন থেকে মাত্র ৫০০ মিটার দূরে কাজীরসুরা বাজার। বাজারটির আশপাশে রয়েছে বহু বসতঘর। দ্রুত ভাঙন না ঠেকানো গেলে ঝুঁকির মধ্যে পড়বে অসংখ্য স্থাপনা।
কাজীরসুরা এলাকার বাসিন্দা রহমত ব্যাপারী বলেন, ‘বাজারের পাশে আমার বাড়ি। এখনই নদীর তীর রক্ষায় সরকার যদি স্থায়ীভাবে বাঁধ নির্মাণ করে দেয়, তাহলেই ভাঙন রোধ করা সম্ভব। নয়তো নদীর ভাঙন যেভাবে শুরু হয়েছে, তাতে আমাদের ঘড়বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হবে।’
ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক সাদিকুর মদবর বলেন, ‘দুই বিঘা জমির এক আনিও আর নাই। নদীর ভাঙনে কিচ্ছু আর পইড়া থাকে না, সব শ্যাষ কইরা দিয়া যায়। ঘরের জায়গাটা ভাঙনের থেকে একটু দূরে আছে। ওইডাও থাকবে না।’
পানি উন্নয়ন বোর্ড মাদারীপুর কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী পার্থ প্রতিম সাহা বলেন, ‘বন্দরখোলা এলাকায় বালুভর্তি ব্যাগ ফেলে ডাম্পিং করে ভাঙন রোধ করা সম্ভব নয়। ওই এলাকায় স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ করা হবে। আগামী বছর থেকেই আশা করছি, বাঁধ নির্মাণের কাজ শুরু হবে।’
উপজেলা প্রশাসন ও প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার কার্যালয়ের সূত্র জানায়, চলতি বছর শিবচর উপজেলায় নদীভাঙনে ৭৩৮ কোটি ৫৫ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। এর মধ্যে ৩ হাজার ৩৩০টি পাকা ও আংশিক পাকা ঘর, ১৩ হাজার ৯৫০টি আধা পাকা ঘর ও ৬১ হাজার ৫৭৯টি কাঁচা ঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ ছাড়াও ২৩টি সেতু ও ১৩টি কালভার্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। নদীর ভাঙনে ২২ কিলোমিটার পাকা সড়ক ও ১৫ কিলোমিটার কাঁচা সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ভাঙনে প্রাথমিক বিদ্যালয় ৭২টি ক্ষতিগ্রস্ত ও ২টি বিলীন এবং মাধ্যমিক বিদ্যালয় ১০টি ক্ষতিগ্রস্ত ও ২টি বিলীন হয়েছে। তা ছাড়া মাদ্রাসা একটি বিলীন ও একটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
শিবচর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আসাদুজ্জামান বলেন, বন্যা ও নদীভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছে। সেই তালিকা অনুসারে তাদের সরকারি সহযোগিতা দেওয়া হবে। আর যাদের বসতঘর ও স্থাপনা নদীতে বিলীন হয়েছে, তাদের জন্য সরকার থেকে বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।