কাঁদতে কাঁদতে কুয়েটছাত্র অন্তুর মা বলছিলেন, ‘আমার সব ফুরোয় গেল’

কুয়েট শিক্ষার্থী অন্তু রায়ের মায়ের আহাজারি
ছবি: প্রথম আলো

খুলনা-সাতক্ষীরা মহাসড়কের গুটুদিয়া বাসস্ট্যান্ডের সামনে থেকে গ্রামের ভেতর নেমে গেছে পাকা রাস্তা। রাস্তা ধরে প্রায় এক কিলোমিটার এগোতেই পশ্চিম গুটুদিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। স্কুলের ঠিক উল্টো পাশের বাড়ি থেকে ভেসে আসছিল কান্নার শব্দ। উঠানে বসে এক নারীকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন কয়েকজন। যাঁরা সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন, তাঁদের চোখেও জল। ওই নারীর একমাত্র ছেলে হারানোর বেদনা ছুঁয়ে যাচ্ছিল সবাইকে।

ডুকরে ডুকরে ওই নারী বারবার বলে উঠছিলেন, ‘আমার বাবা কখন ফিরবে? বাবা আমার কখন ফিরবে? আমার সোনা পাগল আমাগে কই রাইখে গেল। আশাডা নিভে গেল। আমার সব ফুরোয় গেল।’

পশ্চিম গুটুদিয়া গ্রামের দেবব্রত রায়ের বাড়ির উঠোনে গতকাল বুধবার বিকেলে এমন দৃশ্য দেখা গেল। গ্রাম, শহর, এমনকি রাজধানীর অনেক মানুষও এ বাড়িতে ভিড় জমাচ্ছে। তাঁর ছেলে খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) শিক্ষার্থী অন্তু রায়ের অকালমৃত্যুকে কেন্দ্র করে বন্ধু-স্বজন, জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক নেতারা আসছেন। নিচ্ছেন খোঁজখবর, দিচ্ছেন সান্ত্বনা। অভাবের কারণেই অন্তু আত্মহত্যা করেছেন, এমন কথা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। তবে আর্থিক অনটনের কারণে ছেলে এমনটা করেছেন, তা মানতে নারাজ মা, বাবা আর স্বজনেরা।

একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে অনেকটা নির্বাক দেবব্রত রায়। মাঝেমধ্যে একটু-আধটু বলছেন। যখন কথা বলছেন, একনাগাড়ে অনেকক্ষণ বলে আবার চুপ হয়ে যাচ্ছেন। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকছেন এর-ওর মুখের দিকে। দেবব্রত রায় বললেন, ‘আমাদের টাকার কষ্ট অবশ্যই আছে। কিন্তু ছেলেকে কখনো বুঝতে দিইনি। ও যা চেয়েছে দিয়েছি। হয়তো কখনো দেরি হয়েছে। এটা নিয়ে একটা অপপ্রচার চলছে। তবে ও কী অভিমানে, কী কারণে চলে গেল; বুঝতে পারছি না।’

অন্তুর একমাত্র বোন চৈতি রায় ডুকরে ডুকরে কাঁদছিল। বারবার সে নিজেকে দোষারোপ করে বলছিল, ‘আমি পড়তে না গেলে দাদা এটা করতে পারত না। আমারই দোষ, কেন পড়তে গেলাম?’ চৈতিকে বোঝাতে হিমশিম খাচ্ছিলেন স্বজনেরা। এসএসসি পরীক্ষার্থী চৈতিকে পড়তে বের করে দিয়ে গলায় ফাঁস লাগান অন্তু।

দেবব্রত রায় বলেন, ‘আমার মেয়েও মেধাবী। ছেলে কুয়েটে পড়ে। খরচ হয়। এ জন্য আমার মেয়েকে আর বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি করিনি। ওর মা-ও সারা দিন পরিশ্রম করে। সব সময় বলে, ছেলের পড়া শেষ হলে যদি সুখ আসে! সেই কপাল আর হলো না।’

দেবব্রত রায় রাজমিস্ত্রির সহকারীর কাজ করেন। স্ত্রী গীতা রায় কৃষিশ্রমিক। অন্যের জমিতে কাজ করেন। নিজেদের কোনো ফসলি জমি নেই। নিজেদের সাত শতক ভিটায় একটা মাটির ঘর। সেই ঘরের মধ্যে পার্টিশন করে তিন ভাই থাকেন। ঘরের একটা কক্ষ দেবব্রতদের। সেখানেই স্ত্রী-কন্যাকে নিয়ে থাকেন। অন্তু বাড়িতে এলে পাশের বাড়িতে থাকতেন।

পরিবার ও স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অন্তু প্রাথমিক পর্যন্ত পড়ে শহরে তাঁর মাসির ছেলের কাছে চলে যান। মাসির ছেলের কোচিং সেন্টার আছে। তিনি মূলত অন্তুর শিক্ষার খরচ দিতেন। ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে অন্তু শহরের সরকারি মডেল মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। ২০১৬ সালে এসএসসি পরীক্ষা দেওয়ার পর কাউকে না জানিয়ে ভারতে চলে যান। জিপিএ-৫ পাওয়ার খবর পেয়ে আবার দেশে ফিরে আসেন অন্তু। এরপর ভর্তি হন শহরসংলগ্ন রূপসার সরকারি বঙ্গবন্ধু কলেজে।

এরপর অন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য শহরের একটি নামকরা কোচিং সেন্টারে কোচিংয়ের পাশাপাশি প্রাইভেট টিউটরের কাছে পড়াশোনা করেন। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে প্রথমে পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পান। পরে অন্তু কুয়েটের টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে ভর্তি হন।

অন্তুর মাসতুতো ভাই অসীম মণ্ডল বলেন, অন্তুর বাবা ও তিনি মিলে অন্তুর পড়াশোনার খরচ দেখভাল করতেন। ভর্তি পরীক্ষার আগে অন্তুর জন্য প্রতি মাসে তাঁরা ৮ থেকে ৯ হাজার টাকা করে খরচ করেছেন। করোনা শুরুর আগপর্যন্ত তাঁরা একসঙ্গে থাকতেন। করোনার পর অন্তু বাড়িতেই বেশি থাকতেন। মাঝেমধ্যে তাঁর বাসায় থাকতেন। গত বছরের শেষ দিকে দৌলতপুরে একটা বাসায় ওঠেন অন্তু। দিন কয়েক আগে হলে ওঠার কথা জানিয়েছিলেন।

অন্তুর বাবা দেবব্রত রায় বলেন, ‘বাড়িতে অনলাইনে ক্লাস করত অন্তু। মার্চ মাসের ২৭ তারিখ তার দ্বিতীয় বর্ষের চূড়ান্ত মৌখিক পরীক্ষা ছিল। তবে পরীক্ষা দিতে চাচ্ছিল না সে। এরপর ওর দাদাকে (অসীম) বিষয়টি জানাই। সে বাড়িতে এসে বোঝালে ও রাজি হয়। আমাকে বলেছিল, নতুন সেমিস্টারে ভর্তির জন্য ২ হাজার ৮০০ টাকা লাগবে। আর হলে কিছু বাকি আছে। সেটা পরে দিলেও চলবে। আমরা ওকে ৩ হাজার টাকা দিয়েছিলাম। সে টাকা ওর ব্যাগে পেয়েছি। সঙ্গে ওর জমানো কিছু টাকাও ব্যাগে ছিল।’

অসীম বলেন, ‘ওর বন্ধুদের কাছে জেনেছিলাম, অন্তু মৌখিক পরীক্ষা দেওয়ার জন্য বের হলেও পরীক্ষা দেয়নি। হলে খোঁজ নিয়ে দেখেছি, ওর সাড়ে ছয় হাজার টাকা বকেয়া ছিল। মৃত্যুর আগে প্রায়ই সে ফোন বন্ধ রাখত। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও থাকত না। কিছু জানতে চাইলে বলত, একটু নিরিবিলি সময় কাটাতে চায়। যে দিন মারা যায়, তার আগের দিন হলে গিয়ে বিছানাপত্র রেখে আবার বাড়িতে ফিরেছিল। বাড়িতে ফিরে আমাকে ফোনে বলেছিল, কাল সে আমার বাসায় যাবে। ওর কিছু সমস্যার কথা বলবে।’

অন্তুর বন্ধু ফুয়াদুজ্জামান বলেন, ‘আমরা একই বিভাগের, একই হলের। হলে মাত্র সাড়ে ছয় হাজার টাকা বাকি ছিল। আমাদের বকেয়া পরিশোধ নিয়ে কোনো চাপ নেই। অনেকেরই অনেক টাকা বাকি আছে। সে কোনো সাংস্কৃতিক বা রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিল না। প্রেমের সম্পর্ক ছিল, এমনটা শুনিনি। কেন এমন করল, বুঝতে পারছি না।’

গুটুদিয়া ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান মোস্তফা সরোয়ার বলেন, ‘অন্তু খুব ভালো ছেলে ছিল। যেখানেই দেখা হতো, হাসিমুখে কথা বলত। সবার কাছেই প্রিয় ছিল। ওর চলে যাওয়া মেনে নেওয়া যায় না। যতটুকু জানি, আর্থিক সংকটের কারণে ওর মৃত্যু হয়েছে বলে আমার মনে হয় না। এর পেছনে অন্য কোনো কারণ আছে কি না, তা উদ্‌ঘাটন করা উচিত। ওর মধ্যে কোনো অভিমান জন্মেছিল কি না!’