কারুপণ্যে ভাগ্যবদল, সচ্ছলতা

জাহিদ রহমানের কারখানায় প্রতি মাসে চার-পাঁচ লাখ টাকার পণ্য উৎপাদিত হয়। কর্মসংস্থান হয়েছে ১৫ জনের।

কাঠ, বাঁশ, বেত, নারকেলের মালা দিয়ে তৈরি করা হয় কারুপণ্য। গত সোমবার খুলনার রূপসা উপজেলার রামনগর এলাকায়সাদ্দাম হোসেন

কেউ কাঠ ঘষে মসৃণ করছেন, চলছে নকশা, কেউ লাগাচ্ছেন আঠা, কেউবা আবার সেগুলো শুকাচ্ছেন রোদে। নিখুঁতভাবে কাজগুলো হচ্ছে কি না, তা তদারকি করছেন জাহিদ রহমান। এই কারখানায় তৈরি হচ্ছে চোখজুড়ানো সব কারুপণ্য। পঞ্চাশোর্ধ্ব জাহিদের বাড়ি খুলনার রূপসা উপজেলার নৈহাটি ইউনিয়নের রামনগর গ্রামে। গ্রামের বাড়িতেই ছোট্ট কারখানা গড়ে তুলেছেন।

জাহিদের হস্তশিল্পের কারখানা তাঁর নিজের ভাগ্য যেমন বদলে দিয়েছে, তেমনি কারখানায় কর্মসংস্থান হয়েছে ১৫ জন নারী-পুরুষের। তাঁদের বেতন মাসে ৫ থেকে ১৫ হাজার টাকা। জাহিদের কারখানায় প্রতি মাসে চার-পাঁচ লাখ টাকার পণ্য উৎপাদিত হয়। খরচাপাতি বাদ দিয়ে লাভটাও একেবারে কম নয়।

কাজের ফাঁকে কথা হয় কারখানার মালিক জাহিদ রহমানের সঙ্গে। আলাপে আলাপে জানা গেল, দেশ স্বাধীনের আগে জাহিদের বাবা পিরোজপুরের ভান্ডারিয়া উপজেলা থেকে খুলনা এসে রিকশা গ্যারেজের ব্যবসা শুরু করেন। একটা সময় শহরের এক প্রান্ত দিয়ে বয়ে যাওয়া রূপসা নদীর পূর্বপাড়ের রামনগর এলাকায় স্থায়ীও হয়ে যান। আট ভাই–বোনের মধ্যে জাহিদ তৃতীয়। অনেক বড় পরিবারে একটা সময় আর্থিক টানাপোড়েন শুরু হয়। স্থানীয় গাজী মেমোরিয়াল মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক পাসের পর ইচ্ছা থাকলেও তাই পড়ালেখাটা আর এগোয়নি।

কিছু একটা করতে হবে জাহিদের, মনে এই বাসনা তখন প্রবল। খুলনা শহরে হাতের কাজ শেখা শুরু করেন জাহিদ। পরে চট্টগ্রাম শহরে গিয়ে হাত পাকা করেন। ১৯৮৮ সালের দিকে খুলনায় নিজের বাড়িতে ছোট্ট পরিসরে ব্যবসা শুরু করেন। শুরুর দিকে ফুলদানি, আগরদানি, মোমদানি, হাঁড়ি-পাতিল তৈরি করে তা বিভিন্ন মেলায় বিক্রি করতেন। কোনো রকমে চলতে থাকে দিন। ২০০৫ সালে যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ব্যবসার ধরনে পরিবর্তন আনেন। পণ্য তৈরিতে নতুনত্ব আনার চেষ্টা চলতে থাকে। ছোট ছোট যন্ত্রপাতি কিনে পরিসর বাড়াতে থাকেন জাহিদ। ২০১০ সালে কারখানায় লোক নিতে শুরু করেন। কারখানার নাম দেন ‘আপন হ্যান্ডিক্রাফটস’। এরপর শুধু সামনে এগিয়ে চলা।

জাহিদ রহমান বলেন, ‘কাঠের তৈরি হস্তশিল্পের সব ধরনের পণ্যই তৈরি করি। তবে এখন আমি জোর দিয়েছি নানা নকশার বিভিন্ন ধরনের ল্যাম্প, আয়না আর টিস্যু বক্স তৈরিতে। কাঠ, বাঁশ, বেত, নারকেলের মালা—এসব উপাদান দিয়ে পণ্য তৈরি হয়। মূল উপাদান সংগ্রহ করে বাকি সব প্রক্রিয়া এখানেই করা হয়। নকশা নিজেই করি। আপন হ্যান্ডিক্রাফটসের তৈরি বিভিন্ন ধরনের টেবিল ল্যাম্প দেশের বিভিন্ন জেলা ও দেশের বাইরে যাচ্ছে। ল্যাম্পসহ সব পণ্যই ঢাকায় পাইকারিতে বিক্রি করা হয়।’

সম্প্রতি জাহিদের কারখানায় গিয়ে দেখা যায়, প্রচুর পরিমাণে কাঠ আর নারকেলের মালা (কোকোনাট শেল) স্তূপ করা। শ্রমিকেরা ওইসব কাঠ ও নারকেল মালা নিয়ে কাজ করছেন। বিরামহীন কাজ চলছে। একেকজনের কাজের ধরনও আলাদা। টেবিল ল্যাম্প, টিস্যু বক্সসহ নানা ধরনের কারুপণ্য তৈরি হচ্ছে।

কারখানার শ্রমিক অসীমা রানী বলেন, ‘আগে বাড়িতে বসে থাকতাম। বছর দেড়েক ধরে এখানে কাজ করি। আমরা মতো আরও নয়-দশজন নারী এখানে কাজ করছেন। টিস্যু বক্স, আয়না, ফটো ফ্রেম, কলমদানি, ঢোল, পলো মূলত এসব তৈরি করি আমরা। এখান থেকে যে টাকা পাই, তা দিয়ে সংসারে সচ্ছলতা এসেছে।’

একটি কক্ষে যন্ত্রের মাধ্যমে নারকেল মালা মসৃণ করতে করতে রাকিব বলেন, ‘আগে বেকার ছিলাম। দুই বছর ধরে এখানে কাজ করছি। এখান থেকে মাসে আট-নয় হাজার টাকা পাচ্ছি।’

ঢাকায় পণ্য বিক্রির পাশাপাশি খুলনা নগরের গল্লামারী বাসস্ট্যান্ড এলাকায় পণ্য প্রদর্শন ও বিক্রির জন্য সম্প্রতি একটি দোকান নিয়েছেন জাহিদ রহমান। তিনি বলেন, করোনাকালে ব্যবসায় ভাটা পড়েছিল। এখন মোটামুটি চলছে।