করোনাকালে রোগীতে ভরে উঠছে হাসপাতাল। প্রয়োজনীয় ওষুধ, চিকিৎসা সরঞ্জাম, অক্সিজেনসহ দেখা দিচ্ছে নানা সংকট। ঠিক এ সময়ে খরচ করতে না পারায় পাবনার ২৫০ শয্যার জেনারেল হাসপাতাল থেকে উন্নয়ন ও রাজস্ব বরাদ্দের প্রায় ৪ কোটি টাকা ফেরত চলে গেছে।
সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারদের দাবি, দরপত্রের পুরো প্রক্রিয়া শেষ হলেও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এবং হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা ও অবহেলার কারণেই বরাদ্দের টাকা কাজে লাগানো যায়নি। এতে একদিকে ঠিকাদারেরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। অন্যদিকে সেবা থেকে বঞ্চিত হতে যাচ্ছেন রোগীরা।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও ঠিকাদারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত বছরের ২৪ এপ্রিল হাসপাতালের চিকিৎসা ও চিকিৎসা সরঞ্জাম (এমএসআর) কেনার জন্য রাজস্ব তহবিল থেকে ৪ কোটি ১১ লাখ ৭৯ হাজার ৮২৭ টাকা বরাদ্দ আসে। কর্তৃপক্ষ ২ কোটি ৬৮ লাখ টাকার ওষুধ কেনে। একই সঙ্গে ১৫ লাখ টাকার অক্সিজেন কেনা এবং অক্সিজেন ও ওষুধ পরিবহনে ১০ লাখ টাকা ব্যয় করে। এরপর চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে উন্নয়ন তহবিল থেকে ১ কোটি ৪০ লাখ ও এপ্রিলে ১ কোটি ৪০ লাখ টাকা বরাদ্দ হয়। কিন্তু এই টাকা ব্যবহারের কোনো ব্যবস্থা করতে না পারায় গত ২৭ জুন ২ কোটি ৮০ লাখ টাকা ফেরত নিয়ে নেয় স্বাস্থ্য বিভাগ। বাকি টাকার ওষুধপত্র, সার্জিক্যাল যন্ত্রপাতি, গজ-ব্যান্ডেজ, কটন, কেমিক্যাল রিএজেন্ট, আসবাব কিনতে গত ২৮ মার্চ উন্মুক্ত দরপত্র আহ্বান করা হয়। ২২ এপ্রিল পর্যন্ত দরপত্র বিক্রি ও জমা নেওয়ার দিন ধার্য করা হয়। ২৫ এপ্রিল ধার্য হয় দরপত্র উন্মুক্ত করার দিন।
ঠিকাদারদের দাবি, নির্ধারিত সময়ে দরপত্র প্রক্রিয়া শেষ করতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ব্যর্থ হয়। পরে করোনার অজুহাতে দরপত্র বিক্রি ও জমার মেয়াদ বৃদ্ধি করে ৫ মে ধার্য করে। একই সঙ্গে দরপত্র উন্মুক্তর দিন ধার্য হয় ৯ মে। ওই দিন ৬টি গ্রুপে আটজন ঠিকাদার ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জাম সরবরাহের জন্য চূড়ান্ত হন। এরপর গত ১৬ জুন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কাছে প্রশাসনিক অনুমোদন চেয়ে চিঠি দেয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। এই অনুমোদনপত্রে স্বাক্ষর হয় ২৯ জুন। কাগজটি হাসপাতালে পৌঁছায় ৩০ জুন সন্ধ্যায়। এর মধ্যেই শেষ হয়ে যায় অর্থবছরের হিসাবের সময়। ফলে ফেরত চলে যায় পুরো টাকা।
হাসপাতাল সূত্র জানায়, দীর্ঘদিন ধরে হাসপাতালটি নানা সংকটে ভুগছে। ২০০৯ সালে চারটি কার্ডিয়াক মনিটর ও আইসিইউ শয্যা এসেছে। একটি হাই ফ্লো নাজাল ক্যানুলা রয়েছে। কেন্দ্রীয় অক্সিজেনব্যবস্থা না থাকায় কিছুই চালু হয়নি। গত জুনে কেন্দ্রীয় অক্সিজেনব্যবস্থা চালুর কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও এখনো শেষ হয়নি। বর্তমানে অনেকগুলো সিলিন্ডার একসঙ্গে করে কেন্দ্রীয় অক্সিজেন প্লান্টের মতো ব্যবহার করা হচ্ছে।
২৫০ শয্যার হাসপাতালটির মেডিসিন ওয়ার্ডে ১৫০ শয্যায় করোনা ইউনিট খোলা হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত রোগী ভর্তি আছেন ১১৮ জন। সাধারণ ওয়ার্ডে ভর্তি আছেন ২৬২ জন।
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ কমিটি (ক্যাব) পাবনা শাখার সভাপতি এ বি এম ফজলুর রহমান বলেন, এমনিতেই করোনার এই সময়ে হাসপাতালটিতে করুণ দশা তৈরি হয়েছে। রোগীরা প্রয়োজনীয় চিকিৎসা, অক্সিজেন ও ওষুধ পাচ্ছে না। এ সময়ে বরাদ্দের টাকা ফেরত যাওয়া মানে মানুষের হক নষ্ট করা।
টাকা ফেরতের পেছনে কারও গাফিলতি থাকলে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত বলে মনে করেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ পাবনা জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক কামরুন্নাহার।
হাসপাতালের একজন দাপ্তরিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, দরপত্রপ্রক্রিয়া শেষ করতে কিছু সময় বেশি লেগেছে, এটা ঠিক। তবে বিষয়টি নিয়ে স্বাস্থ্য বিভাগও আন্তরিক ছিল না। তাঁরা একদম শেষ সময়ে প্রশাসনিক অনুমোদন দিয়েছে।
ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স সেলিম এন্টারপ্রাইজের মালিক মো. সেলিম হোসেন বলেন, ‘দেরিতে হলেও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ অর্থবছর শেষ হওয়ার ১৫ দিন আগে অনুমোদন চেয়ে চিঠি দিয়েছিল। কিন্তু স্বাস্থ্য বিভাগ সেটি ফেলে রাখায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।’
জানতে চাইলে হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত সহকারী পরিচালক চিকিৎসক মো. সালেহ মোহাম্মদ আলী প্রথম আলোকে বলেন, অনুমোদন পেতে দেরি হওয়ার কারণেই অর্থবছর শেষ হয়ে গেছে। শেষ পর্যন্ত আমাদের আর কিছু করার থাকেনি। স্বাস্থ্য বিভাগের পরামর্শ অনুযায়ী, পরে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।