খালের বুকে ওভারপাস প্রকল্পের পিলার, পানিপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা

ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত শহর খালে পাইলিং করা স্থানে জমে আছে পানিছবি: প্রথম আলো

আশুগঞ্জ-আখাউড়া স্থলবন্দর পর্যন্ত চার লেন মহাসড়ক প্রকল্পের অংশ হিসেবে ওভারপাস নির্মাণ করা হচ্ছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহর খালের (টাউন খাল) ওপর। ওভারপাসের একটি পিলার পড়ছে খালের মাঝখানে। এরই মধ্যে শেষ হয়েছে পাইলিংয়ের কাজ। পিলারটি হলে খালের পানিপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। সেই সঙ্গে খালটি শত বছরের ঐতিহ্য হারাবে বলেও মনে করছেন কেউ কেউ।

তিতাস নদের সঙ্গে সংযুক্ত শহরের টানবাজার ও কান্দিপাড়া এলাকা থেকে খালটি শুরু হয়ে শহরের গোকর্ণঘাট দিয়ে আবার তিতাসের সঙ্গেই মিলিত হয়েছে। পৌরসভা সূত্রে জানা গেছে, খালের দৈর্ঘ্য ৪ দশমিক ৮০ কিলোমিটার। প্রস্থ ৫০-৯০ ফুট, গভীরতা ২০-৩০ ফুট। তবে জেলা পরিষদের খতিয়ান অনুযায়ী খালের আয়তন ৮ দশমিক ৩৫ একর। খালটি জেলা পরিষদের হলেও এর গভীরতা ও প্রশস্ততার কোনো হিসাব তাদের কাছে নেই।

২০০৮-২০১২ সাল পর্যন্ত পৌরসভা বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে প্রায় সাত কোটি টাকা ব্যয়ে সৌন্দর্যবর্ধনের অংশ হিসেবে টানবাজার ও কান্দিপাড়া এলাকা থেকে ঘোড়াপট্টির সেতু (ফকিরাপুল) হয়ে কাজীপাড়া পর্যন্ত খালের দুই পাড়ে সিসি ব্লক ফেলা হয়। নির্মাণ করা হয় ফুটপাত, স্থাপন করা হয় রেলিং। এর পর থেকে জেলা পরিষদ বা পৌরসভা কেউই খালের রক্ষণাবেক্ষণ করেনি। সময়ের সঙ্গে কমে এসেছে খালের প্রশস্ততা ও গভীরতা। এর মধ্যে খালের বুকে পড়ছে পিলার।

খালের মাঝখান থেকে পিলার নির্মাণের বিষয়টি নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান, জেলা প্রশাসক ও জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানের কাছে তিনি লিখিতভাবে জানিয়েছেন। তাতে কোনো সাড়া মেলেনি। মাঝখানে পিলার হলে নাব্যতা–সংকট, নৌকা চলাচলসহ পানিপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হবে।
শামীম আহমেদ, সভাপতি , সামাজিক সংগঠন নোঙর

পৌরসভার ৬ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ওমর ফারুক প্রথম আলোকে বলেন, খালের মাঝখানে পিলার হলে পানিপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হবে। নাব্যতা–সংকট দেখা দেবে। পানি ফুলে দুই পাশের পাড়সহ বাড়িঘর ভেঙে খালে পড়বে। পাশের নিচু এলাকা পানিতে নিমজ্জিত হবে। কাজ শুরুর সময় কেন বাধা দেননি—এ প্রসঙ্গে ওমর ফারুক বলেন, ‘আমরা সবাই আতঙ্ক ও ভয়ের মধ্যে ছিলাম। কারণ, এটি ভারত-বাংলাদেশের প্রকল্প। তা ছাড়া পাশেই ময়লার স্তূপ ছিল। শ্রমিকেরা রাতে কাজ করেছেন, চোখে পড়েনি। সম্প্রতি পিলার অপসারণে খালের ওই জায়গায় মানববন্ধন করেছি।’

নদীর নিরাপত্তা ও পরিবেশ সুরক্ষার সামাজিক সংগঠন নোঙরের ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সভাপতি শামীম আহমেদের দাবি, খালের মাঝখান থেকে পিলার নির্মাণের বিষয়টি নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান, জেলা প্রশাসক ও জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানের কাছে তিনি লিখিতভাবে জানিয়েছেন। তাতে কোনো সাড়া মেলেনি। মাঝখানে পিলার হলে নাব্যতা–সংকট, নৌকা চলাচলসহ পানিপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হবে।

শহর খালে চলছে পাইলিং
ছবি: সংগৃহীত

সরেজমিন দেখা যায়, আশুগঞ্জ নৌবন্দর থেকে আখাউড়া স্থলবন্দর পর্যন্ত ৫১ কিলোমিটার পর্যন্ত সড়ককে চার লেনে উন্নীতকরণের কাজ চলছে। কুমিল্লা-সিলেট মহাসড়কের ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের পৈরতলা সেতুসংলগ্ন শহর খালের মাঝামাঝি অংশে প্রকল্পের রেলওয়ে ওভারপাসের পিলার স্থাপনের জন্য পাইলিংয়ের কাজ শেষ হয়েছে।
স্থানীয় প্রবীণ ব্যক্তি রহিম মিয়া, কামাল মিয়া ও শাহনুর রহমান জানালেন, এই খালের সঙ্গে শহরের প্রায় সব এলাকার নালা যুক্ত রয়েছে। একসময় খালে পানি তীব্র স্রোতে প্রবাহিত হতো। পণ্যবাহীসহ নানা ধরনের নৌকা চলত। পাড়া-মহল্লার ছোট ছেলেমেয়েরা পানিতে গোসল করত, মাছ ধরত। গৃহিণীরাও গোসলসহ গৃহস্থালির কাজ করতেন। এসব এখন স্মৃতি। খালের মাঝখানে চার লেনের পিলার নির্মাণ করা হলে খালের স্থায়ী ক্ষতি হয়ে যাবে। শত বছরের পুরোনো খালের ঐতিহ্য হারিয়ে যাবে।
আশুগঞ্জ-আখাউড়া চার লেন মহাসড়ক প্রকল্পের বিশ্বরোড মোড় থেকে ধরখার পর্যন্ত অংশের প্রকল্প ব্যবস্থাপক খন্দকার গোলাম মোস্তফা প্রথম আলোকে বলেন, মূল সড়কে রেললাইন থাকায় ওভারপাস নির্মাণের জন্য পিলার স্থাপন করা হবে। বর্তমানে খালের প্রশস্ততা অনেক কম। পৈরতলা অংশে সেতুটির দৈর্ঘ্য ২৫-৩০ ফুট। সেতুসংলগ্ন খালের মাঝখানে দুই মিটার দৈর্ঘ্যের পিলার নির্মাণ করা হবে। খালের ওই অংশে খনন করে প্রায় ২০ মিটার পর্যন্ত প্রশস্ততা বাড়ানো হবে। আশা করা যায়, তখন কোনো সমস্যা হবে না।

পিলারের কারণে খালের পানিপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হবে বলে জানিয়েছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পানি উন্নয়ন বোর্ডের এক প্রকৌশলী। তিনি বলেন, বিষয়টি মাসিক সমন্বয় সভায় আলোচনা হয়েছে। পিলারের পিআর যদি মাটির ওপরে থাকে পানির প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হবে। পিলারের আকারের ওপরও পানির প্রবাহ নির্ভর করে।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌরসভার মেয়র নায়ার কবির প্রথম আলোকে বলেন, খালের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব জেলা পরিষদের। কাজ শুরুর সময় কেন তারা কথা বলেনি বা আপত্তি তোলেনি তারাই ভালো বলতে পারবে। জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শফিকুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘চার লেন প্রকল্পের কেউই আমাদের সঙ্গে কেউ যোগাযোগ করেনি।’ বিষয়টি তিনি এই প্রতিবেদকের কাছ থেকে অবগত হলেন বলে জানালেন।

জেলা প্রশাসক শাহ্গীর আলম প্রথম আলোকে বলেন, চার লেন একটি আন্তর্জাতিক প্রকল্প। সেতুর ওই খানে মাটির নিচে তিন কোটি টাকার কাজ করা হয়েছে। ঈদুর ফিতরের আগের দিন তিনি ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। সে সময় স্থানীয় অনেক লোকজন জড়ো হন। প্রকল্পের কাজ শুরুর সময় পৌর কর্তৃপক্ষ, জেলা পরিষদ, কাউন্সিলর ও স্থানীয় লোকজন কেউ কথা বলেনি। চার লেন প্রকল্প কমিটি একটি বিকল্প উপায় বের করেছে। তারা ওই অংশে পিলারের দুই পাশে খালের প্রশস্ততা বাড়িয়ে দুই পাড়ে গাইড ওয়াল নির্মাণ করে দেবেন বলে জানিয়েছেন।