খাল আটকে কালভার্ট নির্মাণ

বাঁধের কারণে খাল শুকিয়ে গেছে। খালনির্ভর বোরো জমি ফেটে চৌচির। উপায় না পেয়ে কাঁদছেন কৃষকেরা।

খালে বাঁধ দিয়ে বিকল্প সড়ক বানিয়ে পাশে কালভার্ট নির্মাণ করা হচ্ছে। এতে খালে সেচের পানি পাওয়া যাচ্ছে না। গত বুধবার তোলাছবি: প্রথম আলো

বোরো আবাদ নিয়ে কৃষকেরা যখন ব্যস্ত, তখন ভোলায় আন্তমহাসড়কের প্রসস্থতা বাড়ানোর অংশ হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ খালগুলোতে বাঁধ দিয়ে নির্মাণ করা হচ্ছে সেতু-কালভার্ট। এসব বাঁধের কারণে খাল শুকিয়ে খাঁ খাঁ। খালনির্ভর বোরো জমি ফেটে চৌচির। উপায় না পেয়ে কাঁদছেন কৃষকেরা।

৯৪ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের ভোলা-চরফ্যাশন-বাবুরহাট আন্তমহাসড়কের বর্তমান প্রস্থ ১৮ ফুট। এটি ৩০ ফুটে উন্নীত করা হচ্ছে। এর অংশ হিসেবে ভোলা সদর উপজেলার পরানগঞ্জ বাজার থেকে শুরু করে চরফ্যাশন উপজেলার বাবুর হাট বাজার পর্যন্ত ৪টি সেতু ও ৪৩টি কালভার্ট ভেঙে নতুন করে নির্মাণ হচ্ছে।

কৃষকের মতো নিজেকে অসহায় মনে হচ্ছে তাঁর। কেউ সহযোগিতা করছেন না, মাঠের পর মাঠ বোরো ধান পুড়ে যাচ্ছে।
মনির হোসেন, উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা

ভোলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক হাসান ওয়ারিসুল বলেন, ‘কৃষকের আসন্ন ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে জেলা প্রশাসকের সঙ্গে কথা বলেছি। একাধিকবার সড়ক বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলীর সঙ্গে কথা বলেছি। সড়ক বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলীকে আমি অনুযোগের সুরে বলছি, খালের বাঁধ ও সেচসংকট দূর করতে। এতবার বললাম, উনি গুরুত্ব দিচ্ছেন না। বরং বলছেন, তাঁদের এ প্রজেক্ট পিছিয়ে গেলে বিশাল ক্ষতি হয়ে যাবে।’

সরেজমিনে কৃষকসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ভোলার চরফ্যাশন উপজেলার আমিনাবাদ ইউনিয়নের মাঝিরহাটের পাশ দিয়ে তেঁতুলিয়া নদী থেকে উঠে আসা মুখরবান্দা খালটি আমিনাবাদ, আবুবকরপুর, জিন্নাগড়, ওসমানগঞ্জ, আসলামপুর ইউনিয়ন হয়ে মেঘনা নদী থেকে উঠে আসা বেতুয়া খালের সঙ্গে মিশেছে। মেঘনা নদীর পানি লবণাক্ত। আর তেতুলিয়া নদীর পানি স্বাদু।

বোরো আবাদ বাড়ানোর স্বার্থে সর্বশেষ পানি উন্নয়ন বোর্ড আশির দশকে খালটি খনন করে। তখন লবণাক্ত পানির প্রবেশ বন্ধে বেতুয়া খালের মুখে জলকপাট (স্লুইজগেট) বসানো হয়। সেই থেকে তেতুলিয়া নদীর স্বাদুপানি দিয়ে বোরো আবাদ হয়ে আসছে। মুখরবান্দা খাল ও এর শাখাখালগুলোতে এখন আর নৌযান চলে না। তবে শীতের জোয়ারে আসা পানি দিয়ে ওই পাঁচ ইউনিয়নের কয়েক হাজার একর জমিতে বোরো আবাদ করা হয়।

ভোলার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, ৪৭টি সেতু-কালভার্ট নির্মাণ করতে গিয়ে ৪৭টি খালের মধ্যে বাঁধ দিয়েছেন ঠিকাদার। এসব খালের চার–পাঁচটি শাখা খাল রয়েছে, সেগুলো শুকিয়ে গেছে। সে হিসাবে প্রায় ১৪০টি খালের পানি শুকিয়ে গেছে। এতে প্রায় ১২ হাজার হেক্টর বোরোখেত শুকিয়ে গেছে। এক একর জমিতে বোরো আবাদ করতে ৪৫ হাজার টাকা খরচ হয়। সে হিসাবে ১২ হাজার হেক্টরে কৃষক প্রায় ১৩৪ কোটি টাকার ক্ষতিতে পড়ছে।

ভোলা সড়ক বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী নাজমুল ইসলাম বলেন, ‘খালের পানি যদি চলাচল করে, তাহলে সেতু-কালভার্টের কাজ এগোবে না। তারপরও যেখানে সম্ভব হচ্ছে, আমরা নীতিবহির্ভূতভাবে জনস্বার্থে পাইপলাইন টেনে পানি চলাচলের ব্যবস্থা করছি।’

স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, ঠিকাদারেরা খালের মধ্যে বাঁধ দেওয়ার সময় বোরো চাষের কথা মাথায় রাখেননি। খালে পানি ভরে বাঁধ দেওয়া হলে সেচসংকট হতো না।

সেচের পানি না থাকায় ধানখেত ফেটে গেছে। গত বুধবার চরফ্যাশনের ওমরপুর বিলে
ছবি: প্রথম আলো
ভোলার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, ৪৭টি সেতু-কালভার্ট নির্মাণ করতে গিয়ে ৪৭টি খালের মধ্যে বাঁধ দিয়েছেন ঠিকাদার। এসব খালের চার–পাঁচটি শাখা খাল রয়েছে, সেগুলো শুকিয়ে গেছে। সে হিসাবে প্রায় ১৪০টি খালের পানি শুকিয়ে গেছে। এতে প্রায় ১২ হাজার হেক্টর বোরোখেত শুকিয়ে গেছে।

সরেজমিনে দেখা যায়, সেচের অভাবে আসলামপুর ইউনিয়নের আলীগাঁও, ওমরপুর ও খোদেজাবাগ মৌজার ১৫০ হেক্টর (৩৭০ একর) বোরোখেত শুকিয়ে চৌচির হয়ে গেছে। মাটি শুকিয়ে সাদা হয়ে গেছে। ধানের অনেক গাছ হলুদ হয়ে গেছে। অনেক গাছ মরে গেছে। এ প্রতিনিধিকে দেখে কৃষকেরা কান্নায় ভেঙে পড়েন। তাঁরা যেকোনো মূল্যে সেচের পানি চান।

আসলামপুরের আলীগাঁও মৌজার কৃষক ইয়াছিন মাঝি (৬৫) বলেন, তিনি দেড় একর জমিতে বোরো আবাদ করেছেন। এ যাবৎ তাঁর ৭৫ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। খালের পানি শুকিয়ে যাওয়ায় সেচ দিতে পারছেন না। পুকুরের পানি খেতে দিতে দিতে পুকুর শুকিয়ে গেছে। এখন ব্যবহারের পানি নেই।

ওমরপুর বিলের বোরোখেতের স্কিম ব্যবস্থাপক মো. শাজাহান বলেন, ‘সেচ ব্যবস্থাপক হয়েও খেতে পানি দিতে পারছি না। না পারছি খেতের দিকে তাকাতে, না পারছি কৃষকের দিকে তাকাতে। যেদিকে তাকাই, কান্না আসে।’

‘খালের পানি যদি চলাচল করে, তাহলে সেতু-কালভার্টের কাজ এগোবে না। তারপরও যেখানে সম্ভব হচ্ছে, আমরা নীতিবহির্ভূতভাবে জনস্বার্থে পাইপলাইন টেনে পানি চলাচলের ব্যবস্থা করছি।’
নাজমুল ইসলাম, ভোলা সড়ক বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী

ওমরপুর ব্লকের ইউনিয়ন উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা মনির হোসেন জানান, অনেক চেষ্টা করেও ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের উপকার করতে পারেননি। কৃষকের মতো নিজেকে অসহায় মনে হচ্ছে তাঁর। কেউ সহযোগিতা করছেন না, মাঠের পর মাঠ বোরো ধান পুড়ে যাচ্ছে।

সেতু ও কালভার্টগুলো নির্মাণের দায়িত্বে থাকা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ওটিবিএলের প্রকল্প ব্যবস্থাপক শাহনেওয়াজ বলেন, কালভার্টের কাজ প্রায় শেষের দিকে। ২১ দিন পরই তাঁর আওতায় নির্মিত কালভার্টের পাশে করা বাঁধ ছেড়ে দেওয়া হবে।

চরফ্যাশনের ইউএনও বলেন, কুতুবগঞ্জের কৃষকেরা লাঠির মাথায় শুকনা ধানগাছ বেঁধে মিছিল করেছেন, আত্মহুতির হুমকি দিয়েছেন। পরে তিনি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের প্রকৌশলীকে ডেকে বলেছেন, তাঁদের কাজ বন্ধ করতে হবে। বিকল্প পাইপ দিয়ে কৃষকের জন্য পানির ব্যবস্থা করতে হবে। এ কথা বলার পর কুতুবগঞ্জ এলাকায় চিকন পাইপ দিয়ে পানির ব্যবস্থা করেছেন ঠিকাদার। কিন্তু তাতে কৃষকের সমস্যা পুরোপুরি সমাধান হয়নি।