কালীগঞ্জে শ্রমজীবীর হোটেল
খিচুড়ির স্বাদ নিতে লাইন
কালীগঞ্জ উপজেলার বাবলু মিয়া অল্প টাকায় খিচুড়ি বিক্রি করেন। দাম কম হলেও, তাঁর খিচুড়ির মান ভালো।
সকাল সাতটা। বেড়ার ঘর আর টিনের ছাউনির ছোট্ট হোটেলে তখন উপচে পড়া ভিড়। রাস্তায় সারিবদ্ধ মোটরসাইকেলসহ নানা যানবাহন। যশোর থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে এসেছেন শহিদুল ইসলাম। ২৫ কিলোমিটার দূরের শহর ঝিনাইদহ বাইপাস থেকে এসেছেন রকি আহম্মেদ। সবাই এসেছেন ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার বকেরগাছি বাজারে খিচুড়ি খেতে। লাইন দিয়ে সবাই খিচুড়ি নিচ্ছেন।
২০ টাকা প্লেট খিচুড়ির স্বাদে সবাই মুগ্ধ। এই খিচুড়ি থাকে নানা উপাদেয় খাবার উপকরণ। খিচুড়িতে দেওয়া হয় খাসির পায়া, কলিজা ও ডিম ভাজি। তবে খাসির পায়া ও কলিজার জন্য অতিরিক্ত ৬০ ও ডিম ভাজির জন্য অতিরিক্ত ২০ টাকা দিতে হয়ে। অজপাড়াগাঁয়ের একটি বাজারে এভাবে সকালে খিচুড়ি আর সন্ধ্যায় চপ বিক্রি করেন বাবলু মিয়া (৩৮), যা খেতে দূরদূরান্ত থেকে শত শত মানুষ ছুটে আসে।
এ বিষয়ে বকেরগাছি বাজারে একটি চায়ের দোকানে বসে কথা হয় গোলাম রব্বানী নামের এক ব্যক্তির সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, যে জায়গায় খিচুড়ির দোকান হয়েছে, সেটি শ্রমিক মোড় বলে পরিচিত। শ্রমিকদের জন্য স্বল্পমূল্যের খাবারের হোটেলটি এখন সবার কাছে প্রিয় হয়ে উঠেছে। এই হোটেলে প্রতিদিন ৪০০-৫০০ জন খিচুড়ি কিনতে আসেন।
হোটেলের মালিকের দেওয়া সুস্বাদু খাবার সবাইকে মুগ্ধ করেছে। কালীগঞ্জ থেকে খেতে আসা আবির হোসেন নামের এক ব্যক্তি বলেন, অনেক দিন থেকেই হোটেলটির সুনাম শুনেছেন। তাই আজ খেতে এসেছেন। খাবারটাও খুব ভালো বলে মন্তব্য করেন তিনি।
কালীগঞ্জ শহরের বাসিন্দা লস্কর পোলট্রি ফিডসের মালিক মোশারফ হোসেন বলেন, তিনি ১৫ থেকে ১৬ দিন খাবার খেতে গিয়েছেন। হোটেলের পরিবেশ এবং খাবারের মান সবই ভালো লেগেছে।
বাবলু কালীগঞ্জ উপজেলার বহিরগাছি গ্রামের মৃত আবেদ আলীর ছেলে। স্ত্রী, ছেলেমেয়ে নিয়ে ছয়জনের সংসার। কষ্টে চলে তাঁর সংসার। বড় মেয়ে মুন্নিকে বিয়ে দিয়েছেন, ছোট মেয়ে রুনা ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে। আর ছেলে মারুফ (৬) ও মারজানের বয়স তিন মাস।
বাবলু মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, দরিদ্র পরিবারে জন্ম হওয়ায় তেমন পড়ালেখা করতে পারেননি। ছোটবেলা থেকেই অন্যের জমিতে কাজ করতে হয়েছে তাঁকে। ১৫ বছর আগে তিনি এক দিন সিদ্ধান্ত নেন, বাজারে চপের একটি দোকান দেবেন। সেই অনুযায়ী বকেরগাছি বাজারে একটি টংদোকান করে আলু, রসুন, ডিমের চপ বিক্রি শুরু করেন। ১৩ বছর ধরে চপ বিক্রি করছেন তিনি। একসময় তাঁর বানানো চপ খেতে দূরদূরান্ত থেকে মানুষ আসতে শুরু করে। এটা দেখে তাঁর ভালোই লাগে।
বাবলু মিয়া বলেন, ‘প্রায় দুই বছর আগে এক দিন ভোরে হাঁটতে হাঁটতে বাজারে এসে দেখেন, বেশ কিছু শ্রমিক ভ্যানে ও নসিমনে কাজে যাচ্ছেন। ভোরে আজানের পর তাঁরা বাড়ি থেকে বের হন। এরপর চায়ের দোকানে বসে চা-বিস্কুট খেয়ে গন্তব্যে চলে যান। তাঁরা অল্প টাকায় খাবার খুঁজে না পেয়ে না খেয়েই কাজে যান। ভোরে বাড়ি থেকেও খাবার খেয়ে আসা তাঁদের পক্ষে সম্ভব হয় না। এ দেখে তিনি অল্প টাকায় খিচুড়ির হোটেল দেন। ভোরে শতাধিক শ্রমিক কাজে যাওয়ার সময় তাঁর দোকানের খিচুড়ি খেয়ে যান। তাঁদের পাশাপাশি বাজারের অন্য ব্যক্তিরা তাঁর দোকানে খিচুড়ি খেতে আসেন।
বাবলু মিয়া জানান, তিনি নিজে বাসায় মসলা তৈরি করেন। সেই মসলা দিয়ে সব ধরনের খাবার রান্না করেন। ভোর তিনটায় দোকানে আসেন। তারপর রান্না শুরু করে দেন। ফজরের নামাজের পর বিক্রি শুরু হয়। সকাল ৮টার মধ্যে বিক্রি শেষ হয়ে যায়। বিকেল ৪টায় শুরু করেন চপ বিক্রি, চলে রাত ৮টা পর্যন্ত। এভাবে প্রতিদিন ১৪ থেকে ১৫ হাজার টাকার খিচুড়ি বিক্রি করেন তিনি। আর বিকেলে পাঁচ থেকে ছয় হাজার টাকার চপ বিক্রি হয়। যশোর, ঝিনাইদহ, চৌগাছা, ঝিকরগাছা, কোটচাঁদপুর, কালীগঞ্জ, মহেশপুর এলাকা থেকেও তাঁর দোকানে খিচুড়ি খেতে আসেন অনেকে। মোটরসাইকেল, ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়েও আসছেন লোকজন। তাঁর দোকানে এখন ছয়জন কর্মচারী।