আজ মহান দিবস
ঘাটশ্রমিকেরা কাজ করেন ঝুঁকি নিয়ে
নওয়াপাড়ায় ৩০ হাজারের বেশি শ্রমিক কাজ করেন। বছরে ১৫ হাজার কোটি টাকার আমদানি পণ্য খালাস হয়।
ইমদাদুল গাজী (৪৩) ছয় বছর ধরে যশোরের অভয়নগর উপজেলার নওয়াপাড়ায় ঘাটশ্রমিকের কাজ করেন। ভৈরব নদে বার্জ ও কার্গো থেকে বস্তাভর্তি পণ্য মাথায় করে তীরে নামান তিনি। নদের তীর ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা বার্জ ও কার্গো থেকে কাঠের তৈরি একটি সিঁড়ি মাটিতে নামিয়ে দেওয়া হয়। সেখান থেকে ৫০ কেজি ওজনের বস্তা মাথায় নিয়ে এই সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামেন ইমদাদুল। ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। তা ছাড়া পণ্যের ধুলাবালু ও বর্জ্য শরীরে ঢুকে প্রায়ই শরীর খারাপ করে তাঁর।
ইমদাদুল গাজীর বাড়ি সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলায়। নওয়াপাড়ায় একটি বাড়িতে তিনি একাই ভাড়া থাকেন। মা-বাবা, স্ত্রী ও তিন মেয়ে নিয়ে ইমদাদুলের সংসার। তাঁরা থাকেন গ্রামের বাড়িতে।
ইমদাদুল গাজী বলেন, ‘আগে জাহাজ (বার্জ ও কার্গো) থেকে সার, গম, ডাল, বুট ও ছোলা নামাতাম। পরে কয়লার কাজ করতাম।
এখন সিমেন্ট নামাচ্ছি। ৫০ কেজির বস্তা মাথায় নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। একটু অসতর্ক হলে পা পিছলে পড়ে গেলে বড়
ক্ষতি হয়। তা ছাড়া সব সময় পণ্যের ধুলাবালু শরীরে ঢুকতে থাকে। এতে প্রায়ই শরীর খারাপ হয়। শ্বাসকষ্ট, কাশি ও চোখ জ্বালাপোড়া করে। প্রতিদিন ৩০ থেকে ৫০ টাকার ওষুধ লাগে। পেটের দায়ে কাজ করি।’
ইমদাদুল গাজীর মতো নওয়াপাড়া নদীবন্দরে ৩০ হাজারের বেশি ঘাটশ্রমিক প্রতিদিন এভাবে ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছেন। এ পরিস্থিতিতে আজ রোববার বিশ্বে পালিত হচ্ছে মহান মে দিবস।
অভয়নগর উপজেলার কোটা গ্রামের ঘাটশ্রমিক মারুফ ইসলাম (২৮) চার বছর ধরে পণ্য নামানোর কাজ করছেন। তিনি বলেন, ‘প্রতিদিন সকাল সাতটায় কাজ শুরু করি এবং সন্ধ্যা ছয়টায় শেষ করি। প্রতিদিন ২০০ থেকে ২৫০ বস্তা মাল নামাতে পারি। এক বস্তা নামালে ৪ টাকা ২৫ পয়সা পাই। এই কাজে প্রচণ্ড স্বাস্থ্যঝুঁকি ও জীবনের ঝুঁকি আছে। এতে কোনোরকম সহায়তা পাওয়া যায় না। সংসার চালাতে বাধ্য হয়ে এই ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করছি।’
উপজেলার বগুড়াতলা গ্রামের ঘাটশ্রমিক মাসুম শেখ (৩৪) বলেন, ‘রাত্তিরি চোখ জ্বালাপুড়া করে। ঘুমোতি পারিনে। চুলকায়ে সারা গায় ফুসকুনি ওঠে। সবই হচ্চে কয়লার জন্যি। আপাতত কাজ করছি না। শরীর ঠিক হলে করবো।’
ছোট্ট উপজেলা শহর নওয়াপাড়া। বছরে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকার আমদানি পণ্য এখানে খালাস হয়। সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে রাসায়নিক সার, কয়লা, খাদ্যশস্য ও পাথর। শুধু আমদানি পণ্য নয়, প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকার অভ্যন্তরীণ পণ্যের বড় বাজার নওয়াপাড়া। সব মিলিয়ে নওয়াপাড়া এখন প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকার ব্যবসাকেন্দ্র। এই ব্যবসা-বাণিজ্যের ওপর নির্ভর করে কর্মসংস্থান হয়েছে যশোর, খুলনা, নড়াইল, সাতক্ষীরাসহ কয়েকটি জেলার ৫০ হাজার মানুষের।
নওয়াপাড়ার ওপর দিয়ে পাশাপাশি বয়ে গেছে ভৈরব নদ এবং যশোর-খুলনা রেলপথ ও মহাসড়ক। এই তিন পথ নওয়াপাড়ায় এসে সমান্তরাল হয়েছে ১৫০-২০০ মিটার দূরত্বে। তিন পথের যোগাযোগের সুবিধায় দেশের অন্যতম বড় বিপণনকেন্দ্র হয়ে উঠেছে নওয়াপাড়া। নব্বইয়ের দশকের শুরুতে নওয়াপাড়ায় সার, খাদ্যশস্য, রড, পাথর ও সিমেন্ট ব্যবসার ব্যাপক প্রসার ঘটে। ২০১৬ সাল থেকে সেখানে যোগ হয়েছে কয়লা।
বিদেশ থেকে আমদানি করা সার, বিভিন্ন প্রকারের খাদ্যশস্য ও কয়লা বড় জাহাজে করে চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দরে আসে। সেখান থেকে বার্জ ও কার্গোতে তা নওয়াপাড়ায় আনা হয়। ভারত থেকে স্থলপথে আমদানি করা পণ্য রেলে বেনাপোল ও দর্শনা স্থলবন্দর হয়ে নওয়াপাড়ায় আনা হয়। প্রতিদিন ৪০০ থেকে ৫০০ পণ্যবোঝাই বার্জ ও কার্গো নওয়াপাড়ায় ভৈরব নদে অবস্থান করে। সেখান থেকে ট্রাকে করে এবং নদীপথে বার্জ ও কার্গোতে করে দেশের উত্তর, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোতে নেওয়া হয়। প্রতিদিন ৩০ হাজারের বেশি শ্রমিক এসব পণ্য ওঠানো–নামানোর কাজ করেন।
অভয়নগর নওয়াপাড়া পৌর হ্যান্ডলিং শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি ফাল্গুন মণ্ডল বলেন, ‘ভৈরব নদকে কেন্দ্র করে নওয়াপাড়ায় হাজার হাজার কোটি টাকার ব্যবসা-বাণিজ্য চলে। এখানে মৌসুমে সপ্তাহে ৬ দিন ৩০ থেকে ৩৫ হাজার এবং অন্যান্য সময় ২৫ থেকে ৩০ হাজার শ্রমিক কাজ করেন। তাঁরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেন।’