ঘাটে পশুবাহী গাড়ির দীর্ঘ অপেক্ষা
প্রতিবছর কোরবানি ঈদে গোপালগঞ্জ থেকে ঢাকায় গরু এনে বিক্রি করেন খামারি কবির হোসেন (৪৫)। এবারও তিনি দেশি জাতের ১৩টি গরু লালন-পালন করে বড় করেছেন। সেই গরু নিয়ে গত বৃহস্পতিবার বিকেল থেকে মাদারীপুরের বাংলাবাজার ঘাটের টার্মিনালে ফেরি পারাপারের অপেক্ষায় আছেন।
গতকাল শুক্রবার বিকেলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের কান্নাকাটি করার মতো অবস্থা হইছে। গরমে গরুগুলোর অবস্থাও খারাপের দিকে যাচ্ছে। ঢাকায় আজ হাট ধরার কথা ছিল। তা তো হইল না। ঘাট থিকা বাড়ি ফিরে গেলেও গরুগুলো নিয়া কী করুম? হাটে গরুগুলো না বেচতে পারলে আমার খুব ক্ষতি হইয়া যাইবে।’
পদ্মায় স্রোত থাকায় মাদারীপুরের বাংলাবাজার ও মুন্সিগঞ্জের শিমুলিয়া নৌপথে ব্যাহত হচ্ছে ফেরি চলাচল। এ কারণে বাংলাবাজার ফেরিঘাটে রাজধানী ঢাকাগামী দুই শতাধিক গরুবোঝাই ট্রাক আটকা পড়েছে।
একই অবস্থা রাজবাড়ীর দৌলতদিয়া ফেরিঘাটেও। গতকাল সকাল থেকেই দৌলতদিয়া ঘাটে একদিকে ঢাকা ছেড়ে যাওয়া মানুষের ভিড়, বিপরীতে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল ছেড়ে আসা পশুবাহী গাড়ির সারি দেখা গেছে। ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের দৌলতদিয়া ফেরিঘাট থেকে শুরু করে প্রায় চার কিলোমিটারজুড়ে যানবাহনের জট দেখা গেছে।
ঘাট-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দৌলতদিয়ায় ৭টির মধ্যে ছোট-বড় চারটি ঘাট সচল রয়েছে। নদীভাঙনের কবলে পড়ায় ১ ও ২ নম্বর ঘাট বন্ধ রয়েছে। সম্পতি বন্যার পানিতে পন্টুনের র্যামের মাথা তলিয়ে যাওয়ায় ৩ নম্বর ঘাট বন্ধ রয়েছে। চারটি ঘাটের মাত্র ৮টি পকেট দিয়ে এই রুটে সচল ১৫টি ফেরিতে যানবাহন পারাপার করা হচ্ছে। ঘাট-স্বল্পতায় ঢাকামুখী গাড়ি ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে থাকছে। প্রখর রোদের মধ্যে থাকতে থাকতে ঢাকামুখী গবাদিপশু অসুস্থ হয়ে পড়ছে।
এদিকে বাংলাবাজার ঘাটে অপেক্ষারত গরুবোঝাই ট্রাকচালকদের অভিযোগ, জরুরি ভিত্তিতে গরু বহনকারী ট্রাক ফেরি পারাপারের নির্দেশনা থাকলেও ঘাট কর্তৃপক্ষ একটি ফেরিতে দু-তিনটি গরুর ট্রাক ছাড়া অন্য গাড়ি লোড নিচ্ছে। ভিআইপি সেবায় ছোট ও ব্যক্তিগত গাড়িকে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। ঘাট কর্তৃপক্ষ বলছে, পদ্মায় তীব্র স্রোত থাকায় ফেরি পারাপারে দ্বিগুণের বেশি সময় ব্যয় হচ্ছে।
গতকাল বেলা তিনটার দিকে বাংলাবাজারে দেখা যায়, ঘাটের সংযোগ সড়ক ও টার্মিনালে ভরা যানবাহন। শিমুলিয়াগামী প্রতিটি ফেরিতে দুই থেকে তিনটি গরুবোঝাই ট্রাক লোড নিচ্ছে। অপেক্ষমাণ পণ্যবাহী ট্রাক ও গরুবোঝাই ট্রাকগুলো টার্মিনালের আলাদা স্থানে রাখা হয়েছে। ঘাটে রোদের তাপ ও ভ্যাপসা গরমে ট্রাকের ভেতরেই হাঁসফাঁস করছে গরুগুলো। ব্যবসায়ীরা গরুর মাথায় ও শরীরে পানি দিচ্ছে। অনেকে হাতপাখা দিয়ে বাতাস করছেন। দীর্ঘ সময় রোদে থাকায় ট্রাকে থাকা কয়েকটি গরু অসুস্থ হয়ে পড়েছে।
বরগুনা থেকে ট্রাকে ১২টি গরু নিয়ে আসা ব্যবসায়ী মিরাজ হাওলাদার (৫০) বলেন, ‘গ্রাম থিকা দেশি গরু কিনেছি। বেশি দামে বিক্রির আশায় ঢাকা যাচ্ছি। ঘাটে এমন বিপদ জানলে এ ব্যবসা এবার করতাম না। এহনে সময়মতো যেতে না পারলে ভালো দাম তো পামুই না উল্টা গরুগুলো বাঁচানো গেলে হয়।’
দৌলতদিয়া ক্যানাল ঘাট এলাকায় গতকাল সকাল সাড়ে ১০টার দিকে কথা হয় আলী আকবরদের সঙ্গে। তাঁরা চারজন একটি পিকআপে করে দুটি ষাঁড় নিয়ে যাচ্ছেন সাভারের তেঁতুলিয়ায়। জানালেন, ঘাট পার হতে চার ঘণ্টার বেশি সময় ধরে লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন তাঁরা। প্রখর রোদ থেকে রক্ষা করতে কেউ গরুর মাথায় ছাতা ধরে আছেন, কেউ গাছের পাতা দিয়ে ছায়া দেওয়ার চেষ্টা করছেন, কেউ আবার হাতপাখা দিয়ে বাতাস করছেন।
আলী আকবর বললেন, ‘আমাদের থেকে এখন পশুর মূল্য অনেক বেশি হয়েছে। পোষা প্রাণী, বাইরে সহজে বের হয়নি। এখন রোদের মধ্যে গাড়িতে বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না।’
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) দৌলতদিয়া ঘাটের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপসহকারী প্রকৌশলী মো. শাহ আলম বলেন, দৌলতদিয়ায় আরও ৩ নম্বর ঘাট চালুর প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। ঈদের আগে ৩ নম্বর ঘাট চালু করতে পারলে পাঁচটি ঘাট দিয়ে যানবাহন পারাপার সহজ হবে। নদীভাঙন দেখা দেওয়ায় একটু সময় লাগছে বলে জানান।
বিআইডব্লিউটিসি বাংলাবাজার ফেরিঘাটের ব্যবস্থাপক (বাণিজ্য) সালাউদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ঈদ চলে আসায় ঘাটে গরুবোঝাই ট্রাকের প্রচুর চাপ আছে। ১৩টি ফেরিতে এগুলো অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পার করা হচ্ছে। ব্যবসায়ীদের অভিযোগ ঠিক নয় দাবি করে তিনি বলেন, পদ্মায় তীব্র স্রোত থাকায় ফেরি ঘাটে আসতে সময় লাগছে।
বাংলাবাজার ফেরিঘাটের ট্রাফিক পুলিশের পরিদর্শক (টিআাই) জামালউদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ফেরি চলাচল ব্যাহত হওয়ায় টার্মিনালে গাড়ির সংখ্যা বাড়ছেই। বিকেল পর্যন্ত প্রায় ৭০০ গাড়ি পারাপারের অপেক্ষায় আটকা। এর মধ্যে দুই শতাধিক আছে গরুবোঝাই ট্রাক। তবে স্রোতের কারণে ফেরিতে বেশি লোড নেওয়া যাচ্ছে না।