লালপুরের বসন্তপুর বিল
জলাবদ্ধতা সমাধানের প্রকল্প নিয়ে বিরোধ
অধিগ্রহণ ছাড়া জমির মালিকেরা খাল খনন করতে না দেওয়ায় থেমে গেছে প্রকল্পের কাজ। আবারও জলাবদ্ধতার শঙ্কা।
বসন্তপুর বিলের জলাবদ্ধতায় রাজশাহীর বাঘা ও নাটোরের লালপুর উপজেলার ২০ গ্রামের মানুষ ১০ বছর ধরে ভুগছেন। বিলের পানিপ্রবাহের পথে অপরিকল্পিত পুকুর খননের কারণে এ সমস্যার সৃষ্টি হয়। সমাধান হিসেবে একটি খাল সংস্কারের জন্য প্রায় এক কোটি টাকার প্রকল্পের কাজ শুরুর পর থেকে শুরু হয়েছে তুমুল বিরোধ।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, যে খালের সংস্কার করা হচ্ছে, সেখানে ব্যক্তিমালিকানাধীন জমি রয়েছে। খালের সরকারি অংশের সংস্কারকাজ ইতিমধ্যে শেষ হলেও ব্যক্তিমালিকানাধীন অংশ নিয়ে এরই মধ্যে ২৮টি মামলা হয়েছে বলে দাবি করেছে একটি পক্ষ। জমির মালিকেরা বলছেন, সরকার অধিগ্রহণ না করলে তাঁরা খাল খনন করতে দেবেন না। অপর দিকে জলাবদ্ধতার কারণে ভুক্তভোগী মানুষেরা বলছেন, বিলে পুকুরগুলো অবৈধভাবে খনন করা হয়েছে। সেগুলোর পাড় উচ্ছেদ করে তাঁদের জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি দেওয়া হোক।
বসন্তপুর বিলের সিংহভাগ পড়েছে লালপুর উপজেলার দুড়দুড়িয়া ইউনিয়নে। বিলটি প্রায় ১০ কিলোমিটার দীর্ঘ, প্রস্থে প্রায় ৩ কিলোমিটার। এ বিলে প্রায় ১০ হাজার বিঘা আবাদি জমি রয়েছে। অতীতে এ বিলের পানি পার্শ্ববর্তী রঘুনাথপুর, আকবরপুর, হাসিমপুর হয়ে একটি খাল দিয়ে নাটোরের চন্দনা নদীতে পড়ত। তখন এ বিলের এক ইঞ্চি জমিও অনাবাদি থাকত না।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, প্রায় ১০ বছর আগে বিলে বাণিজ্যিকভাবে মাছ চাষের জন্য পুকুর খনন শুরু হয়। নির্বিচারে পুকুর খননের কারণে প্রাকৃতিক পানিপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়। বর্ষায় বাঘা ও লালপুর উপজেলার ২০টি গ্রামের মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়ে। মানুষের ঘরবাড়িতে পানি উঠে যায়। দীর্ঘদিন পানিবন্দী থাকায় এলাকার মানুষ রোগব্যধিতে আক্রান্ত হয়।
এমন অবস্থায় ২০২০ সালের ২৪ আগস্ট লালপুরের তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা উম্মুল বানীন দ্যূতি ভুক্তভোগী চাষিদের দিয়ে ৪২টি পুকুরের পাড় কেটে পানিনিষ্কাশনের ব্যবস্থা করেন। স্থায়ীভাবে পানিনিষ্কাশন ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে নাটোর-১ (লালপুর-বাগাতিপাড়া) আসনের সংসদ সদস্য শহিদুল ইসলাম বসন্তপুর বিলের সঙ্গে চন্দনা নদীর সংযোগ খাল সংস্কারের জন্য প্রায় এক কোটি টাকার একটি প্রকল্পের ব্যবস্থা করেন। গত ১ মার্চ তিনি প্রকল্পের উদ্বোধন করেন।
নব্বইয়ের দশকের শুরুতে দুড়দুড়িয়া ইউনিয়ন পরিষদের তৎকালীন চেয়ারম্যান আজিজুল আলম এলাকাবাসীকে উদ্বুদ্ধ করে তাঁদের জমিতে সরকারি ব্যয়ে এ খাল খনন করেছিলেন। এবার জমির মালিকেরা অধিগ্রহণ ছাড়া আর খাল খনন করতে দেবেন না। এ জন্য তাঁরা একাধিক মামলা করেছেন। এ অবস্থায় ১ জুন বর্তমান চেয়ারম্যান তোফাজ্জল হোসেন খালের জায়গা মাপজোখ করতে গেলে জমির মালিকেরা বাধা দেন। যার সূত্র ধরে দুই পক্ষের মারামারিও হয়।
গত রোববার দুপুরে বসন্তপুর বিলে গিয়ে দেখা যায়, প্রায় এক কিলোমিটার খাল খনন করা হয়েছে। বাকি ১ দশমিক ৫ কিলোমিটার খাল সংস্কার করা সম্ভব হয়নি। গন্ডবিল গ্রামের কৃষক নাজিম উদ্দিন বলেন, খালের দুই পাশে তাঁর পাঁচ বিঘা জমি রয়েছে। আগে জমির দাম কম ছিল। তাই খাল খনন করতে দিয়েছিলেন। এখন আর দেবেন না। এখন নিতে হলে অধিগ্রহণ করে নিতে হবে।
এদিকে ভুক্তভোগীরা গত ১১ মে প্রধানমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরে একটি আবেদন করেছেন। এতে বলা হয়েছে, অনুমোদন ছাড়াই বিলের কৃষি জমিতে যে ৪২টি পুকুর খনন করা হয়েছে। সেগুলোর পাড়কে অবৈধ স্থাপনা ঘোষণা করে উচ্ছেদ করলেই জলাবদ্ধতার সমস্যা আর থাকবে না।
দুড়দুড়িয়া ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান আজিজুল আলম এ খাল খনন করেছিলেন। তিনি বলেন, মামলার নিষ্পত্তি না হলে কেউ খাল খনন করতে দেবেন না।
ইউনিয়নের আরেক সাবেক চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদ বলেন, মামলা নিষ্পত্তি না করে খাল খনন করতে এলে খুনোখুনি হয়ে যাবে।
বর্তমান চেয়ারম্যান তোফাজ্জল হোসেন বলেন, প্রকল্প বাস্তবায়ন না হলো হাজার হাজার মানুষ আবার জলাবদ্ধতায় ভুগবেন।
খাল খনন প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নাটোর কার্যালয়। সেখানকার উপসহকারী প্রকৌশলী আবুল বাশার বলেন, আদালতে বিষয়টি নিষ্পত্তি না হওয়া ছাড়া তাঁরা কাজ এগোতে পারছেন না।
লালপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শামীমা সুলতানা প্রথম আলোকে বলেন, স্থানীয় লোকজন তাঁকে বিষয়টি জানিয়েছেন। এখন জেলা প্রশাসক ও স্থানীয় সংসদ সদস্যের সঙ্গে পরামর্শ করে দুই পক্ষের লোকজন নিয়ে বসার একটা উদ্যোগ নেবেন।