জাহাঙ্গীরের মাথাল সংগ্রহ

নওগাঁর মান্দা উপজেলার কালীগ্রামে জাহাঙ্গীর শাহ প্রতিষ্ঠিত কৃষি তথ্য পাঠাগার ও জাদুঘরে হরেক রকম মাথাল
ছবি: প্রথম আলো

বাংলাদেশে সবচেয়ে মাথাল বেশি ব্যবহার করেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের কৃষকেরা। সেখানকার মাথাল সবচেয়ে বেশি মজবুত। আর দৃষ্টিনন্দন মাথাল তৈরি করেন সিলেট অঞ্চলের কৃষকেরা। আবার ভোলা ও নারায়ণগঞ্জ জেলায় মাথালের তেমন ব্যবহার নেই।

তবে বাংলাদেশ ছাড়া বিশ্বের আরও ১১টি দেশের মাথাল সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সেখানেও কৃষকেরা মাথাল ব্যবহার করেন। একেক দেশের মাথালের গঠন একেক রকম। মজার ব্যাপার হচ্ছে, সব দেশের মাথালই কৃষি উপকরণ দিয়ে তৈরি। নাম কিন্তু হরেক রকম। বাংলাদেশেই একেক জেলায় মাথালের একেক রকম নাম রয়েছে।

মাথাল সংগ্রহ ও মাথাল নিয়ে গবেষণার কাজ শুরু করেছেন বেসরকারি পর্যায়ে দেশের একমাত্র কৃষিতথ্য পাঠাগার ও জাদুঘরের প্রতিষ্ঠাতা জাহাঙ্গীর শাহ। তাঁর বাড়ি নওগাঁর মান্দা উপজেলার কালীগ্রামে। তিনি রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলের শিক্ষক। মাথালের বিচিত্র চেহারা ও নাম জানতে তিনি ১২ বছর ধরে দেশের বিভিন্ন জেলার গ্রামগঞ্জে ঘুরে বেড়িয়েছেন, কথা বলেছেন সাধারণ চাষিদের সঙ্গে। একটি মাথালের জন্য দুর্গম অঞ্চলের অচেনা চাষির বাড়িতে রাত যাপনও করেছেন।

তাঁর গবেষণালব্ধ তথ্যমতে, রাজশাহী অঞ্চলের মাথালকে চট্টগ্রামে জুইর, কুড়িগ্রামে ঝাঁপি, পঞ্চগড়ে ভাতি, টাঙ্গাইলে মাথোল, নড়াইল ও ভোলায় টুয়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও নেত্রকোনায় পাতলা, মৌলভীবাজারে ছাতা, ফেনীতে জোংরা/জুমলা, পটুয়াখালী ও বাগেরহাটে জুমলা বলা হয়। আর বিদেশে ফারমার্স ক্যাপ হিসেবে পরিচিত। আমাদের দেশের মাথালের মধ্যে জোংরা/জুমলা/ জুইরের বিশেষ বৈশিষ্ট্য রয়েছে। সাধারণ মাথালগুলো আকৃতিতে গোল। এটা দিয়ে শুধু মাথার রোদ-বৃষ্টি ঠেকানো যায়। মাথাল সাধারণত আকারে গোল হয়, কিন্তু জোংরা/জুমলা/ জুইর আকারে অনেক বড়। এগুলো গোল হয় না। এটা দিয়ে চাষির মাথা থেকে পিঠ ও কোমর পর্যন্ত ঢেকে রাখেন।

নওগাঁর মান্দা উপজেলার কালীগ্রামে জাহাঙ্গীর শাহর প্রতিষ্ঠিত শাহ কৃষিতথ্য পাঠাগার ও জাদুঘরে দেশের এ রকম ৪২টি জেলার মাথাল এবং ১০টি দেশের ফারমার্স ক্যাপ রয়েছে। এগুলো জাদুঘরে প্রদর্শনের জন্য বিশেষ গ্যালারিতে রাখা হয়েছে। তাঁর জাদুঘরটি ৫০টি কর্নারে ভাগ করা। তার মধ্যে একটি কর্নারে শুধু মাথাল রাখা আছে। জাহাঙ্গীর শাহ সারা দেশে ঘুরে ঘুরে এই মাথাল সংগ্রহ করেছেন। একইভাবে কোন জেলায় মাথালের কী নাম, তা-ও জেনে এসেছেন সেখানকার কৃষকের কাছ থেকে।

জাহাঙ্গীর শাহ জানান, মাথাল নিছক কৃষকের মাথা ঢাকার একটি জিনিস নয়, এটি শিল্পসম্মতভাবে তৈরি একটি কৃষি উপকরণ। প্রাচীনকাল থেকে কৃষকেরা মাথাল ব্যবহার করে আসছেন। এই মাথালগুলো দেখলে তাঁদের ভেতরের শিল্পীসত্তার পরিচয় পাওয়া যায়। একেক অঞ্চলের মাথালের একেক ধরনের বুনন ও গঠন দেখেও কৃষকের বিচিত্র শিল্পীমনের পরিচয় পাওয়া যায়। এই শিল্প দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে। তাই এই ঐতিহ্যকে নতুন প্রজন্মের সঙ্গে পরিচয় করে দেওয়ার জন্যই তিনি এই সংগ্রহশালা গড়ে তুলেছেন।