জীবনে প্রথম নিজেদের বাড়িতে ঈদ উদ্যাপন
আনোয়ারার বয়স এখন ৬৪ বছর। ২০ বছর বয়সে তাঁর বিয়ে হয় পাশের উপজেলার একটি গ্রামে। চার বছর সংসার করার পর স্বামী মোবারক হোসেন দ্বিতীয় বিয়ে করে ৪০ বছর আগে আনোয়ারাকে ছেড়ে চলে যান। তখন দুই বছর বয়সী শিশুসন্তান নিয়ে দ্বারে দ্বারে ঘুরে জীবন চালাতে শুরু করেন আনোয়ারা।
৪০ বছর ধরে ঈদ কাটিয়েছেন মানুষের বাড়িতে। এই বছর আনোয়ারার জীবনে ঈদ এসেছে আশীর্বাদ হয়ে। আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর পেয়ে সেখানে তিনি ঈদ উদ্যাপন করেছেন। শরীয়তপুর সদর উপজেলার চন্দ্রপুর ইউনিয়নের দড়িকান্দি গ্রামের বাসিন্দা আনোয়ারা। ২৬ এপ্রিল আনোয়ারাকে আশ্রয়ণ প্রকল্পের দুই শতাংশ জমি ও একটি ঘর দিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন। আনোয়ারার মতো নিঃস্ব ও ভূমিহীন ২ হাজার ৪৫১টি পরিবার এই প্রথম নিজেদের বাড়িতে ঈদ উদ্যাপন করেছে।
আনোয়ারা বলেন, স্বামী ছেড়ে যাওয়ার পর কিছুদিন মা-বাবার আশ্রয়ে ছিলেন। তাঁরা মারা গেলে সেই আশ্রয়ও হারাতে হয়। কোথায়ও ঠাঁই না পেয়ে আত্মীয়স্বজনের রান্নাঘর, কাছারিঘরের মেঝেতে থেকেছেন বছরের পর বছর। ছেলে গ্রামে ভ্যান গাড়ি চালিয়ে যা আয় করেন, তা দিয়েও সংসার চলত না। একসময় ছেলে বিয়ে করে আলাদা সংসার পাতেন। আবার তাঁকে নামতে হয় রাস্তায়, বেঁচে থাকার তাগিদে করতে হয় ভিক্ষাবৃত্তি। প্রতিটি ঈদ কাটিয়েছেন মানুষের বাড়িতে। সরকারের দেওয়া এবারই প্রথম নিজের ঘরে ঈদ উদ্যাপন করলেন।
শরীয়তপুর জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের আওতায় শরীয়তপুরে কয়েক দফায় ২ হাজার ৪৫১ ভূমিহীন পরিবারকে ঘর নির্মাণ করে দিয়েছে প্রশাসন। তাঁদের প্রত্যেককে দুই শতাংশ করে জমি দলিল করে দেওয়া হয়েছে। ২৬ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রীর ঈদ উপহার হিসেবে ১৭০ পরিবারকে ঘর ও জমির দলিল বুঝিয়ে দিয়েছে জেলা প্রশাসন।
নড়িয়া উপজেলার কলাবাগান গ্রামের মাসুদ মীরের (৩৫) কোনো ঘরবাড়ি নেই। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে অন্যের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন তিনি। রাজমিস্ত্রির সহকারী হিসেবে কাজ করে যা আয় হতো, তা দিয়ে ঘর ভাড়া করার সামর্থ্য ছিল না। মাসুদ ভোজেশ্বর ইউনিয়নের পাঁচক গ্রামে দুই শতাংশ জমিসহ একটি ঘর পেয়েছেন। সেই ঘরে দুই শিশুসন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে ঈদ উদ্যাপন করেছেন তিনি। মাসুদ মীর বলেন, জীবনে কখনো ভাবেননি নিজের একটি ঘর হবে। এই ঘর যাঁরা দিয়েছেন, তাঁদের জন্য প্রাণ ভরে দোয়া করেছেন তিনি।
জাজিরার গোপালপুর ইউনিয়নের উত্তর সিকদার কান্দি গ্রামের ফজলু সিকদার দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী। সহায়-সম্বলহীন ফজলু ঘুরে ঘুরে আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে থাকতেন। স্ত্রী মধুমালা শ্রমিকের কাজ করে যা আয় করেন, তা দিয়েই তিন সন্তানের পড়ালেখা ও সংসার চলত। ফজলু ও মধুমালা দম্পতিকে দুই শতাংশ জমিতে একটি ঘর নির্মাণ করে দিয়েছে সরকার।
ফজলু সিকদার বলেন, প্রতিবছর ঈদে পাড়া-প্রতিবেশীরা ও স্বজনেরা যে খাবার দিতেন, তা দিয়েই ঈদ পার করতেন। জীবনে এবারই প্রথম নিজের ঘরে ঈদের সেমাই ও পিঠা রান্না করা হয়েছে। স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে অনেক আনন্দ আর তৃপ্তি নিয়ে খেয়েছেন।
জেলা প্রশাসক মো.পারভেজ হাসান বলেন, সারা দেশে এমন অসংখ্য মানুষ আছেন, দারিদ্র্য ও অসহায়ত্বের কারণে তাঁদের সুখ চাপা পড়ে যাচ্ছিল। প্রধানমন্ত্রী সেই সব মানুষের সুখের সন্ধান দিচ্ছেন। মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকার জন্য বাড়ি বানিয়ে দিয়েছেন। তাঁরা আর অবহেলার ভিড়ে হারিয়ে যাবেন না। প্রধানমন্ত্রীর সুখের দাওয়াই নিয়ে তাঁরা পাশে আছেন।