জীববৈচিত্র্য রক্ষায় সেন্ট মার্টিনে নিষিদ্ধ হচ্ছে টমটম ও মোটরসাইকেল
বঙ্গোপসাগরের টেকনাফ উপকূলে ৮ বর্গকিলোমিটার আয়তনের প্রবালদ্বীপ সেন্ট মার্টিনে নিষিদ্ধ হচ্ছে ব্যাটারিচালিত টমটম ও মোটরসাইকেলসহ যন্ত্রচালিত যানবাহনের চলাচল। আগামী পর্যটন মৌসুম থেকে (নভেম্বর) এ সিদ্ধান্ত কার্যকর করবে উপজেলা প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তর। তবে আগের মতোই চলবে পেডালচালিত ভ্যানগাড়ি। পরিবেশ অধিদপ্তর কক্সবাজার কার্যালয়ের উপপরিচালক শেখ মো. নাজমুল হুদা প্রথম আলোকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
সেন্ট মার্টিনে বর্তমানে নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে চলাচল করছে ৩৭১টি টমটম ও ২৬৫টি মোটরসাইকেল। পর্যাপ্ত সড়ক না থাকায় যন্ত্রচালিত এসব যানবাহন যাত্রী নিয়ে সৈকতের বালুচর দিয়ে চলাচল করে। এতে দ্বীপের কাঁকড়া, শামুক-ঝিনুকসহ জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হচ্ছে।
জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালক শেখ মো. নাজমুল হুদা বলেন, জানুয়ারি মাসে সেন্ট মার্টিনের সুরক্ষায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে ১৩ দফা বাস্তবায়নের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে দ্বীপে হোটেল-রিসোর্ট-কটেজসহ যেকোনো ধরনের স্থাপনা নির্মাণ বন্ধ, পর্যটকের উপস্থিতি সীমিতকরণ, ময়লা-আবর্জনা ও পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থার সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা এবং দ্বীপে মোটরযানের চলাচল নিষিদ্ধের নির্দেশনা রয়েছে। আগামী নভেম্বর মাস থেকে নতুন পর্যটন মৌসুম শুরু হবে। তখন অন্যান্য নির্দেশনা বাস্তবায়নের পাশাপাশি দ্বীপে টমটম ও মোটরসাইকেলের চলাচলও নিষিদ্ধ করা হবে। তবে পর্যটক ও স্থানীয় ব্যক্তিদের দুর্ভোগ লাঘবে আগের মতো ভ্যানগাড়ি চলবে।
সম্প্রতি দ্বীপ ঘুরে দেখা গেছে, কয়েক কিলোমিটারের পাকা সড়কে চলছে সাড়ে তিন শতাধিক টমটম ও আড়াই শতাধিক মোটরসাইকেল। দ্বীপের দক্ষিণ পাশের জেটিঘাট থেকে পর্যটক নিয়ে টমটমগুলো ছড়িয়ে পড়ে উত্তর, পশ্চিম, দক্ষিণ ও পূর্ব দিকের এলাকায়। সেখানে ইতিমধ্যে তৈরি হয়েছে ১৮৮টি হোটেল, রিসোর্ট, কটেজ ও বাংলোবাড়ি।
২ এপ্রিলের আগপর্যন্ত দৈনিক ১০টি জাহাজ, ৫০টির বেশি স্পিডবোট ও কাঠের ট্রলারে প্রতিদিন টেকনাফ থেকে দ্বীপ ভ্রমণে গেছেন অন্তত পাঁচ হাজার পর্যটক। তাঁদের রাতযাপনের জন্য দ্বীপে তৈরি হওয়া ১৮৮টি হোটেল, রিসোর্ট ও কটেজের কোনোটির পরিবেশ ছাড়পত্র নেই। এসব আবাসনে নেই পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থাও। ফলে এগুলো থেকে বর্জ্য সমুদ্রের পানিতে মিশে দূষণের সৃষ্টি করছে। দ্বীপের ১১ হাজার মানুষের জীবনযাত্রা এ দূষণের কারণে শঙ্কায় রয়েছে।
জানতে চাইলে সেন্ট মার্টিন অটোরিকশা, মিনি টমটম ও ভ্যান মালিক সমবায় সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ ইসহাক প্রথম আলোকে বলেন, সমিতির নিবন্ধিত টমটম আছে ১৩০টি। এর বাইরে অনিবন্ধিতভাবে চলছে আরও ১৬০টির বেশি টমটম। এত টমটম চলার জন্য পাকা রাস্তা নেই দ্বীপে। ফলে বাধ্য হয়ে অনেকে সমুদ্রসৈকতের বালুচর দিয়ে টমটম চালাচ্ছেন। এতে ডিম পাড়তে আসা মা কচ্ছপ, কচ্ছপের ডিম, কাঁকড়া, শামুক-ঝিনুকসহ জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হচ্ছে। সমিতিভুক্ত টমটম বালুচরে না নামার বিষয়ে কড়া নির্দেশনা দেওয়া হলেও সমিতির বাইরের টমটমগুলো নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না। এসব টমটমচালকেরা লোকজনের কাছ থেকে অতিরিক্ত ভাড়াও আদায় করছেন।
দুই বছর আগেও দ্বীপে কোনো টমটম ছিল না বলে জানিয়েছেন সেন্ট মার্টিনের সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান নুর আহমদ। তিনি বলেন, তখন এত মোটরসাইকেলও চলতে দেখা যায়নি। পর্যটকদের বহনে কেবল চার চাকার ভ্যানগাড়ি চলাচল করত। রাষ্ট্রপতি, মন্ত্রী, সচিব, সাংসদ, রাজনৈতিক দলের নেতা—যাঁরাই দ্বীপ ভ্রমণে এসেছেন, সবাই ভ্যানগাড়িতে চড়েছেন। এখন ভ্যানগাড়ি বিলুপ্তির পথে। ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত টমটম ও মোটরসাইকেল চলাচলের কারণে দ্বীপের পরিবেশ-প্রতিবেশ হুমকিতে পড়েছে। ধ্বংস হচ্ছে জীববৈচিত্র্য।
সেন্ট মার্টিন অটোরিকশা, মিনি টমটম ও ভ্যান মালিক সমবায় সমিতি সূত্র জানায়, আগে সমিতির আওতাভুক্ত ভ্যানগাড়ি ছিল ১৮৬টি। টমটম চলাচল শুরুর পর থেকে ভ্যানগাড়ির ব্যবহার কমতে থাকে। এখন দ্বীপে চলছে মাত্র ১০টি ভ্যানগাড়ি। টমটম বন্ধ হলে সমিতির পক্ষ থেকে আবার ভ্যানগাড়ি চালু করা হবে।
এ বিষয়ে দ্বীপের কয়েকজন ইউপি সদস্যের সঙ্গে কথা হয়। তাঁরা বলেন, দ্বীপে বর্তমানে টমটম চলছে সাড়ে তিন শতাধিক। মোটরসাইকেল প্রায় ২৮০টি। বাইসাইকেল চলে ৫০০টি। মোটরসাইকেল ঘণ্টায় ভাড়া ৫০০ টাকা। আর সাইকেল ৬০ টাকা। হাঁটার রাস্তায় যানবাহন চলাচল কিংবা সারিবদ্ধভাবে টমটম ফেলে রাখায় মানুষের চলতে সমস্যা হয়। এখন থেকে এসব যন্ত্রচালিত যানবাহন চলাচল বন্ধ করা উচিত।
টমটম ও মোটরসাইকেল সেন্ট মার্টিনের জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের অন্যতম কারণ বলে মনে করেন পরিবেশবাদী সংগঠন কক্সবাজার বন ও পরিবেশ সংরক্ষণ পরিষদের সভাপতি দীপক শর্মা। তিনি বলেন, আগে পর্যটকেরা স্পিডবোট নিয়ে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে যেতেন সেন্ট মার্টিনের আরেক বিচ্ছিন্ন দ্বীপ ছেঁড়াদিয়ায়। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশনা জারির পর টেকনাফ উপজেলা প্রশাসন ফেব্রুয়ারি মাস থেকে ছেঁড়াদিয়ায় নৌযানে চড়ে পর্যটকের যাতায়াত বন্ধ করে দিয়েছে। এই সুযোগটি লুফে নেন টমটমের মালিক ও চালকেরা। প্রতিদিন ৩০-৪০টি টমটম পর্যটক বোঝাই করে সৈকতের বালুচরের ওপর দিয়ে দ্বীপের একেবারে দক্ষিণ পাশে চলে যাচ্ছে। সেখান থেকে পর্যটকেরা পায়ে হেঁটে যাচ্ছেন ছেঁড়াদিয়ায়। এতে প্রবাল-শৈবালসহ জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হচ্ছে।
দীপক শর্মা আরও বলেন, টমটম ও মোটরসাইকেল বন্ধের ব্যাপারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা নেই। যদিও দ্বীপে এসব মোটরযানের চলাচল, বিক্রি ও পরিবহন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
এ বিষয়ে কথা হয় সেন্ট মার্টিনের বর্তমান ইউপি চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমানের সঙ্গে। তিনি বলেন, জীববৈচিত্র্য রক্ষার স্বার্থে দ্বীপের টমটম ও মোটরসাইকেল চলাচল সীমিত করা হচ্ছে। ইউপি চেয়ারম্যান আরও বলেন, দ্বীপে পাকা রাস্তা আছে তিন কিলোমিটারের মতো। আর কাঁচা রাস্তা আরও আট কিলোমিটার। এর মধ্যে সাত কিলোমিটারের বঙ্গবন্ধু সড়কটি পাকাকরণের চেষ্টা চলছে।