টিসিবির পণ্য কিনতে এক ট্রাক থেকে আরেক ট্রাকে ঘুরতেই দুপুর
ভাড়ায় অটোরিকশা চালান মো. সিদ্দিক। সাশ্রয়ী মূল্যে পণ্য কিনতে টিসিবির (ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ) ট্রাকের লাইনে এসে দাঁড়িয়েছেন সকাল সাড়ে ৯টায়। এক ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকে ট্রাকের কাছে পৌঁছালে কর্তৃপক্ষ জানায়, এখানে তাঁর নাম নেই। অন্য এলাকার ট্রাক থেকে তাঁকে পণ্য নিতে হবে।
পরে সেই এলাকায় দৌড়ে যান সিদ্দিক। সেখানকার ট্রাক কর্তৃপক্ষ তাঁকে প্রথম ট্রাক থেকে পণ্য নেওয়ার পরামর্শ দেয়। এভাবেই দৌড়াদৌড়ির মধ্যে সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়। দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত তিনি পণ্য কিনতে পারেননি। গরমে ক্লান্ত হয়ে একটি গাছের নিচে দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি। তাঁর মতো সাশ্রয়ী মূল্যে পণ্য কিনতে এসে বহু মানুষ এমন হয়রানির শিকার হচ্ছেন। পণ্য বিক্রির সময় কোনো ধরনের শৃঙ্খলা লক্ষ করা যায়নি।
সিদ্দিকের বাড়ি জামালপুর পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডের ছাতার মোড় এলাকায়। তাঁর সঙ্গে আজ দুপুরে পাথালিয়া পশ্চিমপাড়া এলাকায় এই প্রতিবেদকের কথা হয়। প্রথম আলোকে মো. সিদ্দিক বলেন, ‘স্যাররে (ট্রাকে দায়িত্বরত ব্যক্তি) কাগজ দিলাম, স্যার কাগজ দেইখা কইল, পশ্চিমপাড়া যাও গা, দৌড়ায় আইলাম পশ্চিমপাড়া, এহন আবার পশ্চিমপাড়া থাইকা কইতাছে যাও গা ছাতার মোড়ে। আবার ছাতার মোড় গেলাম। ছাতার মোড় থেকে আবার পশ্চিমপাড়া আইলাম। এই যে চার-পাঁচবার পাকটা পাড়লাম, এইডা কোনো হইল। দিনটাই তো কামাই (মাটি) হইল। রইদের মধ্যে ৪৬০ টেহার (টাকা) মাল নিবার আইয়া, এক হাজার টেহার লুকসান। তিন দিন ধইরা পাক-পাড়তেছি। এইডা কোনো উপকার। ক্ষতিই বেশি আমগোরে।’
সিদ্দিকের মতো একই অভিযোগ পাথালিয়া এলাকার মো. হযরত আলীর, সালমা বেগম, শফিকুল ইসলাম, বদিউজ্জামান, রুমি বেগমসহ অনেকের। আজ সকাল ১০টার দিকে জামালপুর পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডের পশ্চিমপাড়া এলাকায় পবিত্র রমজান উপলক্ষে ভর্তুকি মূল্যে নিম্নআয়ের পরিবারের মধ্যে টিসিবির নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য বিক্রির কার্যক্রমের শুভ উদ্বোধনের কথা ছিল। ফলে সকাল ৯টা থেকে লোকজন অপেক্ষা করছিলেন। সেই কার্যক্রম উদ্বোধন হয় ১০টা ৪৫ মিনিটে। মানুষের ব্যাপক ভিড়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা তাঁদের লাইনে দাঁড় করানোর চেষ্টা করেন।
লাইনে দাঁড়ানো বদিউজ্জামান গরমে উত্তেজিত হয়ে পড়েন। ক্ষুব্ধ হয়ে তিনি বলেন, এই উপকারের মানে কী? সকাল ৯টার দিকে এসে দাঁড়িয়েছেন লাইনে। ৫০০ টাকা দিন হাজিরা কাজ করেন। আজ তো কাজে যেতে পারলেন না। তাহলে ৪৬০ টাকার মাল কিনতে এসে ৫০০ টাকার ক্ষতি হয়ে গেল।
রইদের মধ্যে ৪৬০ টেহার (টাকা) মাল নিবার আইয়া, এক হাজার টেহার লুকসান। তিন দিন ধইরা পাক-পাড়তেছি। এইডা কোনো উপকার। ক্ষতিই বেশি আমগোরে।
সকাল ৯টা থেকে বৃদ্ধ নারী সালমা বেগম লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে অনেক কষ্টে ট্রাকের কাছে পৌঁছান। তবে ট্রাকের লোকজন ফ্যামিলি কার্ডটি হাতে নিয়ে সেখানে থেকে তাঁকে ছাতার মোড় যেতে বলেন। পরে তিনি সেখানে তাঁর কার্ডটি বিভিন্ন জনকে দেখাচ্ছিলেন। সালমা বলেন, স্বামী মারা গেছেন ২০ বছর আগে। দুই মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। কেউ নেই। গবাদিপশু লালন–পালন করেন, বৃদ্ধ বয়সে কোনো রকমে চলেন। কম দামের পণ্য কিনতে এসে তিনি হয়রানির শিকার হচ্ছেন। প্রায় দুই কিলোমিটার হেঁটে তাঁকে ছাতার মোড় যেতে হবে। তাঁর বাড়ি পশ্চিমপাড়া।
পশ্চিমপাড়া পণ্য বিতরণ কার্যক্রমের ট্যাগ অফিসার শাহ আলম প্রথম আলোকে বলেন, এলাকায় যেসব ফ্যামিলি কার্ড বিতরণ করা হয়েছে, সেখানে কোনো এলাকার নাম উল্লেখ নেই। শুধু আছে ওয়ার্ড নম্বর। ফলে এই সমস্যাটা হচ্ছে। এক এলাকার লোক আরেক এলাকায় চলে আসছে। শুধু কার্ড দিয়েই মাল দেওয়া যাচ্ছে না। তালিকার সঙ্গে কার্ড মেলাতে হচ্ছে। রেজিস্ট্রার মেইনটেইন করতে হচ্ছে। ফলে একটু দেরি হচ্ছে।
জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, জেলা ২ লাখ ৩৩ হাজার ৭২৪টি পরিবারের মধ্যে এসব পণ্য বিক্রি করা হবে। জেলার ৭টি উপজেলা, ৮টি পৌরসভা ও ৬৮টি ইউনিয়নে পর্যায়ক্রমে টিসিবির পণ্য বিক্রি হবে। প্রতি পরিবার দুই কেজি তেল, দুই কেজি চিনি ও দুই কেজি মসুর ডাল পাবে।
জামালপুর সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) লিটুস লরেন্স চিরান প্রথম আলোকে বলেন, অল্প সময়ের মধ্যে তালিকা তৈরি করার কারণে কিছু সমস্যা আছে। তারপর আজই প্রথম শুরু হয়েছে। তবে এসব সমস্যা চিহ্নিত করা হয়েছে। এই ধরনের সমস্যা যাতে না হয় এবং দ্রুত সময়ের মধ্যে যাতে পণ্য কিনে নিতে পারেন কার্ডধারীরা, সেই ব্যবস্থা করা হবে।