ট্রাফিক অব্যবস্থাপনায় ঝুঁকিতে নৌপথ

ঢাকা থেকে বরিশাল, ঝালকাঠি, বরগুনা, পটুয়াখালী, আমতলী, ভোলা, মেহেন্দীগঞ্জসহ বিভিন্ন নৌপথে কয়েকটি ডুবোচর রয়েছে।

শীতে অধিক কুয়াশা, নাব্যতা-সংকট ও ডুবোচরের কারণে ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করে যাত্রী ও পণ্যবাহী নৌযান। সে ঝুঁকি আরও বাড়ে যখন নৌপথে সংকেতবাতি, বয়া ও মার্কার না থাকে। বরিশাল বিভাগের ৩১টি নৌপথের মধ্যে ২২টিতে পানির গভীরতা কমে গেছে। তার ওপর সংকেতবাতি ও বয়া না থাকায় প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা।

সর্বশেষ গত ২৩ ডিসেম্বর রাতে ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে ঢাকা থেকে বরগুনাগামী অভিযান-১০ নামে একটি লঞ্চে অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটে। ঘন কুয়াশার কারণে লঞ্চটি কিনারে নোঙর করাতে না পেরে মাঝনদীতে চালকবিহীন ভাসছিল। এতে অগ্নিদগ্ধ হয়ে এ পর্যন্ত ৪৭ জনের মৃত্যু এবং অন্তত ৩১ জন নিখোঁজ রয়েছেন।

নৌ চলাচলে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের দায়িত্ব বিআইডব্লিউটিএর। কিন্তু নৌপথে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় সংস্থাটির ঘাটতি দেখছেন নিরাপদ নৌপথ রক্ষা আন্দোলনের আহ্বায়ক তুসার বেহমান। গতকাল তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘নৌপথে চরম অব্যবস্থাপনা আমরা দূর করতে পারিনি। আবার প্রতিনিয়ত নদীগুলোর চরিত্র প্রাকৃতিক ও জলবায়ুগত কারণে পরিবর্তন হচ্ছে। ডুবোচর, নৌযান ডুবে গিয়ে ঝুঁকি তৈরি করছে।’

লঞ্চের মাস্টার-চালকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ঢাকা থেকে বরিশাল, ঝালকাঠি, বরগুনা, পটুয়াখালী, আমতলী, ভোলা, মেহেন্দীগঞ্জসহ বিভিন্ন নৌপথে বেশ কয়েকটি স্থানে ডুবোচর রয়েছে। আবার ২২টি স্থানে আছে নাব্যতা-সংকট। শীতে তা তীব্র আকার ধারণ করে। আবার অনেক স্থানে বয়া থাকলেও তাতে সংকেতবাতি জ্বলে না।

৪ জানুয়ারি ঢাকা থেকে দক্ষিণাঞ্চলে আসার পথে চাঁদপুরের মাঝেরচর খালের মুখে হালিমা সোবাহান নামে একটি পণ্যবাহী কার্গো ডুবে যায়। সংকেতবাতি না থাকায় রাতে ওই স্থান খুবই ঝুঁকি নিয়ে অতিক্রম করতে হচ্ছে নৌযানগুলোকে। এই এলাকায় ২০২০ সালের ১২ জানুয়ারি বরিশাল থেকে ঢাকাগামী এমভি কীর্তনখোলা-১০ লঞ্চের সঙ্গে ঢাকা থেকে হুলারহাটগামী ফারহান-৯ লঞ্চের সংঘর্ষে দুই যাত্রী নিহত ও তিনজন গুরুতর আহত হন। এ জন্য মাঝেরচরের খাড়ি এলাকাটি জরিপ করে সংকেতবাতি স্থাপন করা দরকার বলে মনে করেন নৌযানের মাস্টার ও চালকেরা। এ ছাড়া মেঘনা নদীর কালীরগঞ্জ থেকে শেওড়া গ্রিন বয়া পর্যন্ত নাব্যতা-সংকট প্রকট।

নৌপথে চরম অব্যবস্থাপনা আমরা দূর করতে পারিনি। আবার প্রতিনিয়ত নদীগুলোর চরিত্র প্রাকৃতিক ও জলবায়ুগত কারণে পরিবর্তন হচ্ছে। ডুবোচর, নৌযান ডুবে গিয়ে ঝুঁকি তৈরি করছে
নিরাপদ নৌপথ রক্ষা আন্দোলনের আহ্বায়ক তুসার বেহমান

বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) সূত্র জানায়, ঢাকার সদরঘাট থেকে ৪৪টি নৌপথে প্রতিদিন ২২১টির মতো লঞ্চ চলাচলের অনুমতি থাকলেও প্রতিদিন গড়ে চলাচল করে ৮৫টি। এসব নৌপথের ৩১টিই বরিশাল বিভাগের; এর মধ্যে ২২টিতেই পানির গভীরতা কমে গেছে। এই বিভাগে নৌপথ রয়েছে ১ হাজার ৪৭৫ কিলোমিটার।

সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা যায়, বরিশালের হিজলা থেকে বাবুগঞ্জ খাঁড়ির মুখ এলাকাটিও ঝুঁকিপূর্ণ। সেখানেও বয়া-বাতি নেই। ওই এলাকার নলবুনিয়ায় বয়া থাকলেও সংকেতবাতি না থাকায় এলাকাটি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। ঝালকাঠি থেকে বরগুনা চ্যানেলে ঢোকার পথে চল্লিশ কাউনিয়ার বাঁ পাড়ে চরের মাথায় মার্কার, সংকেতবাতি কিছুই নেই। এই পথে হদুয়ার ডান পাড়ে চরের মাথায়ও কোনো সংকেতবাতি নেই। এ ছাড়া নিয়ামতি ঘাটের ডানে-বাঁয়ে মার্কা, সংকেতবাতি নেই। আবার নিয়ামতি থেকে বরগুনার বেতাগী পর্যন্ত বিষখালী নদীতে কোনো মার্কার, সংকেতবাতি নেই। একই অবস্থা ঢাকা-ভোলা নৌপথের। ভোলার ইলিশার জনতা বাজার এলাকায় সংকেতবাতি নেই। একইভাবে সাদেকপুর পন্টুনের কাছে বাতি নেই। ডান পাশের টেকে বাতি নেই, শ্রীপুরের আগে মাচকাজীর পাড়েও কোনো সংকেতবাতি নেই।

পর্যাপ্ত সংকেতবাতি, বয়া ও মার্কার না থাকায় প্রায়ই ঘটছে নৌ দুর্ঘটনা। ২০২১ সালের ১২ আগস্ট রাত তিনটার দিকে ঢাকা থেকে বরগুনাগামী অভিযান-১০ সহস্রাধিক যাত্রী নিয়ে ঝালকাঠি থেকে বরগুনা চ্যানেলে ঢোকার পথে চল্লিশ কাউনিয়ার বাঁ পাড়ের ডুবোচরে আটকে যায়। একই স্থানে পূবালী-১ ডুবোচরে আটকে গিয়েছিল। ২০১৯ সালের ১৪ ডিসেম্বর রাতে বরিশাল নদীবন্দরের সামান্য দূরে চর কাউয়া এলাকায় বরগুনা থেকে ঢাকাগামী এমভি শাহরুখ-২-এর সঙ্গে সংঘর্ষে কীর্তনখোলা নদীতে ডুবে যায় ১ হাজার ২০০ বস্তা ক্লিংকারবোঝাই কার্গো এমভি হাজি দুদু মিয়া।

জানতে চাইলে নিরাপদ নৌপথ রক্ষা আন্দোলনের আহ্বায়ক তুসার বেহমান প্রথম আলোকে বলেন, রাত্রিকালীন জাহাজ চলাচলে নদ-নদীর অববাহিকা, বাঁক, ডুবোচর ও চর এলাকায় বয়া, সংকেতবাতি, মার্কার—এসব থাকার কথা থাকলেও এ নিয়ে যুগ যুগ ধরে তুঘলকি কাণ্ড চলছে। এগুলো নিয়মিত সংরক্ষণ, পর্যবেক্ষণে থাকলে অনেক দুর্ঘটনা এড়ানো যেত।

বরিশাল-ঢাকাগামী এমভি সুন্দরবন-১০ লঞ্চের মাস্টার রুহুল আমিন বলেন, ঢাকা-বরিশাল পথের অধিকাংশ লঞ্চ নতুন প্রজন্মের হওয়ায় এসব লঞ্চে রাডার, ইকোসাউন্ডারসহ আধুনিক দিকনির্ণয় যন্ত্র থাকায় এই ঝুঁকি কম। তবে অন্যান্য পথে চলাচলকারী কোনো লঞ্চের অপারেটিং ও ট্রাফিক সিস্টেম আধুনিক নয়। ফলে এসব লঞ্চের চালকেরা একরকম আন্দাজ করে চলাচল করেন।

বরিশাল বিআইডব্লিউটিএর নৌ সংরক্ষণ ও পরিচালন বিভাগের যুগ্ম পরিচালক এস এম আজগর আলী প্রথম আলোকে বলেন, ঢাকা-বরিশালসহ দক্ষিণাঞ্চলের নৌপথে সংকেতবাতি দেওয়া আছে। আবার অনেক জায়গায় বাতি ও ব্যাটারি নষ্ট হয়ে যাওয়ায় ঠিকমতো কাজ করছে না। ব্যাটারি ও বাতি দেওয়ার জন্য প্রধান কার্যালয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে। বরিশালের শ্রীপুর থেকে পায়রা সমুদ্রবন্দর পর্যন্ত নৌপথটি বন্দর কর্তৃপক্ষের আওতায় থাকায় ওই অংশ বন্দর কর্তৃপক্ষ সংরক্ষণ করে।