ঢাকঢোল পিটিয়ে সাপে কাটার ‘চিকিৎসা’, পুলিশ দেখে পালালেন কবিরাজ

সাপে কাটা তরুণীর বাড়ির উঠানে শামিয়ানা টানিয়ে চলছে কথিত চিকিৎসা। বরিশালের বাবুগঞ্জ উপজেলার আগরপুর গ্রামে
ছবি: প্রথম আলো

দুই দিন ধরে ঢাকঢোলসহ বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে সাপে কাটা এক তরুণীর অভিনব চিকিৎসা করছিলেন কথিত এক কবিরাজ ও তাঁর দল। এমন ‘চিকিৎসা’ দেখতে সেখানে ভিড় জমান আশপাশের মানুষ। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে গেলে পালিয়ে যান সেই কবিরাজ এবং তাঁর দলের সদস্যরা।

ঘটনাটি ঘটেছে বরিশাল জেলার বাবুগঞ্জ উপজেলার জাহাঙ্গীর নগর ইউনিয়নের আগরপুর গ্রামে। পরে পুলিশ অসুস্থ ওই তরুণীকে উদ্ধার করে বরিশাল শের-ই–বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠান। সেখানে চিকিৎসায় সুস্থ হয়ে আজ বৃহস্পতিবার বাড়ি ফিরেছেন ওই তরুণী।

ভুক্তভোগী পরিবার জানায়, কথিত ওই কবিরাজের নাম মো. আলী আকবর হোসেন (৩৫)। তাঁর বাড়ি মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলার দক্ষিণ রমজানপুর গ্রামে। তাঁর দলের সদস্যরা হলেন দক্ষিণ রমজানপুর গ্রামের তফেল উদ্দীন, হাফিজুল ইসলাম, মো. বাপ্পি, আবু হানিফ ও শাজাহান মিয়া।

স্থানীয়রা জানান, রোববার রাতে আগরপুর গ্রামের ওই তরুণীকে সাপ বা বিষাক্ত কোনো পোকা কামড় দেয়। এতে তিনি আতঙ্কিত হয়ে পড়লে তাঁকে ওই রাতেই কালকিনিতে কবিরাজ আলী আকবর হোসেনের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। ঝাড়ফুঁক শেষে আবার বাড়ি ফিরে মঙ্গলবার ওই তরুণী অসুস্থ হয়ে পড়েন। ওই দিন আলী আকবরকে খবর দিয়ে বাড়িতে নিয়ে আসেন তরুণীর স্বজনেরা।

কবিরাজ ও তাঁর দল এসে বাড়ির উঠানে শামিয়ানা টানিয়ে কলাগাছ লাগান। এরপর মোমবাতি, আগরবাতি ও ধূপ জ্বালিয়ে তরুণীকে ঘেরাও দেওয়া সীমানার মধ্যে একটি চেয়ারে বসিয়ে কথিত ‘মন্ত্র’ চিকিৎসা শুরু করেন কবিরাজ ও তাঁর দল। একই সঙ্গে ঢাকঢোলসহ বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে ‘মন্ত্র’ পড়ে তরুণীকে ঝাড়ফুঁক দিতে থাকেন কবিরাজ। মঙ্গলবার গড়িয়ে বুধবার (৯ জুন) পর্যন্ত চলে ঝাড়ফুঁক। এই ‘চিকিৎসা’ দেখতে আশপাশের এলাকার হাজার হাজার মানুষের ভিড় জমে ওই বাড়িতে।

সাপে কাটা রোগীকে প্রাথমিক চিকিৎসার পর দ্রুত হাসপাতালে নিতে হবে। সাপে কাটা রোগীকে তাবিজ, ঝাড়ফুঁক কোনো স্বীকৃত চিকিৎসা নয়। এতে রোগীর ভালো হওয়ার কোনো নিশ্চয়তা নেই। এটি সম্পূর্ণ ভাঁওতাবাজি।
মনোয়ার হোসেন, বরিশাল জেলা সিভিল সার্জন

খবর পেয়ে জাহাঙ্গীর নগর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান তারিকুল ইসলাম বুধবার রাত সাড়ে আটটার দিকে পুলিশ নিয়ে ঘটনাস্থলে যান। পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে কবিরাজ ও তাঁর দল সবকিছু ফেলে রেখে সটকে পড়েন। পরে পুলিশ তরুণীকে উদ্ধার করে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করায়।

তরুণীর স্বজনেরা জানান, আলী আকবর বাড়িতে এসে জানান, তরুণীকে বিষধর সাপে কামড়েছে শুধু ঝাড়ফুঁকে নয়, লাগবে ‘তান্ত্রিক’ চিকিৎসা। এ জন্য তরুণীর বাবার কাছ থেকে ৪৫ হাজার টাকা দাবি করেন। পরে তাঁর সঙ্গে ৩৭ হাজার টাকার চুক্তি হয়। কবিরাজ দলের খাওয়া-থাকা, ডেকোরেশনসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধাও তাঁদের বহন করার কথা ছিল। তিন থেকে সাত দিনের মধ্যে রোগীকে সুস্থ করে তোলার নিশ্চয়তা দেন কবিরাজ।

বৃহস্পতিবার সকালে তরুণীর বাবা জানান, এই কবিরাজ এমন অনেক রোগী এর আগেও ভালো করেছেন বলে তিনি শুনেছিলেন। তাঁর গ্রামের এক ব্যক্তির মাধ্যমে তিনি যোগাযোগ করেন। চুক্তির ৩৭ হাজার টাকা চিকিৎসার আগেই নিয়ে নেন কবিরাজ। বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসার পর তাঁর মেয়ে এখন পুরোপুরি সুস্থ বলে জানান তিনি।

জাহাঙ্গীর নগর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান তারিকুল ইসলাম বলেন, সাপে কাটা রোগীর চিকিৎসার নামে যা করা হচ্ছিল তা চিকিৎসা নয়, ভন্ডামি। গ্রামের মানুষ খুব সহজে এসব কবিরাজের কথায় বিশ্বাস করে প্রতারিত হচ্ছেন।

আগরপুর পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের ইনচার্জ (আইসি) পরিদর্শক মহিদুল আলম বলেন, চেয়ারম্যানের খবর পেয়ে পুলিশ পাঠানো হয়। কিন্তু তার আগেই কথিত কবিরাজ তাঁর দল নিয়ে পালিয়ে যান। এলাকার মানুষকে পুলিশের মুঠোফোন নম্বর দেওয়া হয়েছে। কবিরাজ ওই এলাকায় ঢোকামাত্রই তাঁকে আটক করা হবে।

বরিশাল জেলা সিভিল সার্জন মনোয়ার হোসেন বলেন, সাপে কাটা রোগীকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া উচিত। বিষধর সাপের কামড়ে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মৃত্যুর মূল কারণ যথাযথ সচেতনতার অভাব। সাপে কাটা ব্যক্তিকে প্রথমে আশ্বস্ত করতে হবে যে তাঁর ভয়ের কোনো কারণ নেই। এর বৈজ্ঞানিক চিকিৎসা আছে। বেশির ভাগ সাপই নির্বীষ, এমনকি বিষধর সাপের পক্ষেও দংশনের সময় সব সময় প্রচুর পরিমাণ বিষ ঢেলে দেওয়া সম্ভব হয় না। প্রাথমিক চিকিৎসার পর দ্রুত হাসপাতালে নিতে হবে। তিনি আরও বলেন, সাপে কাটা রোগীকে তাবিজ, ঝাড়ফুঁক কোনো স্বীকৃত চিকিৎসা নয়। এতে রোগীর ভালো হওয়ার কোনো নিশ্চয়তা নেই। এটি সম্পূর্ণ ভাঁওতাবাজি।