সিলেটে প্রথমবারের মতো হাফ ও মিনি ম্যারাথন
‘তরুণ সমাজকে মাদক থেকে দূরে রাখতে এমন আয়োজন গুরুত্বপূর্ণ’
বয়স ৭০ ছুঁই ছুঁই নৃপেন চৌধুরীর। তাঁর মাথায় পাকা চুল, চোখে ভারী চশমা। এরপরও তিনি সমান তালে দৌড়েছেন পাঁচ শতাধিক তরুণ ও যুবকের সঙ্গে। তিনি যখন সাড়ে সাত কিলোমিটার দৌড় শেষ করলেন, তখন তাঁকে দৌড় প্রতিযোগিতার সব অংশগ্রহণকারী এবং উপস্থিত দর্শক হাততালি দিয়ে অভিবাদন জানান। মিনি ম্যারাথনের ৫০–ঊর্ধ্ব ক্যাটাগরিতে প্রথম স্থান লাভ করেন তিনি।
আজ শুক্রবার সিলেট রানার্স ক্লাবের আয়োজনে অনুষ্ঠিত ‘ব্র্যান্ডসলেন্সার সিলেট হাফ ম্যারাথন ২০২০’ আয়োজনে প্রবীণ অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে প্রথম হয়েছেন নৃপেন চৌধুরী। দৌড় শেষ করে তিনি বলেন, ২০১৬ সালের পর থেকে এখন পর্যন্ত ম্যারাথনের ৪৫টি ইভেন্টে অংশগ্রহণ করেছেন। এর মধ্যে ভারতে অনুষ্ঠিত ম্যারাথনেও অংশ নিয়েছেন। এর মধ্যে কয়েকটিতে ভালো ফলাফল করেছেন তিনি। এ ছাড়া চলতি বছর যুক্তরাজ্যে ম্যারাথনে অংশগ্রহণের আমন্ত্রণও পেয়েছিলেন। তবে করোনার কারণে অংশ নিতে পারেননি।
নৃপেন চৌধুরী বলেন, ‘কর্মক্ষেত্র থেকে স্বেচ্ছায় অবসর নিয়েছি। এখন আমি দৌড়ানোকে শরীরচর্চার অন্যতম মাধ্যম ও খেলাধুলার অংশ হিসেবে সারা দেশে প্রচারণা চালানোর চেষ্টা করছি। এরই মধ্যে দেশের ৬৪ জেলার কয়েকটিতে গিয়ে আমি নিজে সেখানকার বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে যোগাযোগ করে প্রচারণা চালিয়েছি।’
ম্যারাথন শুরু হয় সকাল ছয়টায়। তবে এর আগেই কিন ব্রিজ এলাকায় প্রতিযোগী এবং উৎসুক মানুষের ভিড় জমে ছিল। সকাল ছয়টায় নগরের কিন ব্রিজ থেকে হাফ ম্যারাথন শুরুর ১০ মিনিট পর একই এলাকা থেকে মিনি ম্যারাথনও শুরু হয়। পরে নগরের বিভিন্ন সড়ক দিয়ে বিমানবন্দর সড়ক হয়ে লাক্কাতুর এলাকার সিলেট সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ে গিয়ে মিনি ম্যারাথন শেষ হয়। অন্যদিকে হাফ ম্যারাথনের প্রায় ৪০০ প্রতিযোগী বিমানবন্দর এলাকার বাইশটিলা এলাকা প্রদক্ষিণ করে সিলেট সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ে গিয়ে শেষ করেন। এ সময় সড়কে দাঁড়িয়ে অনেককে হাততালি দিয়ে প্রতিযোগীদের উৎসাহিত করতে ও মুঠোফোনে ছবি তুলতে দেখা যায়।
আয়োজকদের দেওয়া তথ্যে জানা গেছে, প্রথমবারের মতো সিলেট রানার্স কমিউনিটি হাফ ম্যারাথন (২১ দশমিক ১ কিলোমিটার) এবং মিনি ম্যারাথনের (৭ দশমিক ৫ কিলোমিটার) আয়োজন করে। হাফ ও মিনি ম্যারাথনের দুই বিভাগে ৯৩৩ জন দৌড়বিদ অংশ নেন। এর আগে দুই বিভাগে সহস্রাধিক প্রতিযোগী নিবন্ধন করেছিলেন। হাফ ম্যারাথনের প্রতিযোগীদের সময় ছিল সাড়ে ৩ ঘণ্টা এবং মিনি ম্যারাথনের প্রতিযোগীদের সময় ছিল ১ ঘণ্টা ১৫ মিনিট। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে যাঁরা দৌড় শেষ করতে পেরেছেন, তাঁদের প্রত্যেককে দেওয়া হয়েছে ‘ব্র্যান্ডসলেন্সার সিলেট হাফ ম্যারাথন ২০২০’ পদক।
প্রতিযোগিতায় হাফ ম্যারাথনে অংশ নিয়ে পুরুষ বিভাগে প্রথম হয়েছেন আল আমিন, দ্বিতীয় হয়েছেন মাহবুবুর রহমান ও তৃতীয় আশরাফুল আলম। নারী বিভাগে প্রথম হয়েছেন শারওয়াল পারভিন, দ্বিতীয় হয়েছেন ফাহমিদা জেবা ও তৃতীয় রোদেলা দোলা। মিনি ম্যারাথনে পুরুষ বিভাগে প্রথম হয়েছেন সাজ্জাদ স্নিগ্ধ, দ্বিতীয় খাইরুল বাশার এবং তৃতীয় হয়েছেন মনসুর আহমেদ। নারী বিভাগে প্রথম হয়েছেন শারমিন সুপ্তা, দ্বিতীয় নাসরিন বেগম ও তৃতীয় নদী ওয়াহাব। মিনি ম্যারাথন পঞ্চাশোর্ধ্ব বিভাগে প্রথম হয়েছেন নৃপেন চৌধুরী, দ্বিতীয় হয়েছেন শচীন্দ্র অধিকারী ও তৃতীয় হয়েছেন আবদুল মোনায়েম।
ম্যারাথনে অংশ নেওয়া আবদুল মোনায়েম বলেন, বর্তমানে তরুণেরা ঘরে বসে মুঠোফোনে খেলাধুলা এবং ডিজিটাল মাধ্যমে আনন্দ খুঁজে বেড়াচ্ছেন। এতে শরীরে অলসতা ভর করবে এবং পরিশ্রম করা সম্ভব হবে না। নানা রোগ জেঁকে বসতে পারে। পরনির্ভরশীলতা বৃদ্ধি পাবে। এ জন্য তরুণ প্রজন্মকে শারীরিক কসরত, বিশেষ করে দৌড়ানোর প্রতি আগ্রহ বাড়াতে হবে।
হাফ ম্যারাথনে অংশ নেওয়া নারী প্রতিযোগী রোদেলা দোলা বলেন, ‘এমন প্রতিযোগিতায় কখনো অংশ নিইনি। তবে নিয়মিত সাইক্লিং করতাম। প্রথমে মনে করেছিলাম পারব না। তবে শুরুর পর সবার উৎসাহ দেখে অনুপ্রেরণা পেয়েছি।’
ম্যারাথনে অংশ নেওয়া রাজন দাশ বলেন, ‘কর্মক্ষেত্রে বসে বসে কাজ করি। ঘরে ফেরার পরও কম্পিউটার, মুঠোফোনে টুকটাক কাজ করি। এসব করে শরীর অনেকটা বসে গেছে। আগে একসময় নিয়মিত হাঁটাহাঁটি করলেও এখন কয়েক মাস ধরে সেটি বন্ধ। সিলেটে ম্যারাথন আয়োজনের খবর পেয়ে নিবন্ধন করেছি। তবে ২১ কিলোমিটার পথ দৌড়ানো সম্ভব হবে কি না, তা নিয়ে সংশয়ে ছিলাম। প্রতিযোগিতায় কয়েজন প্রবীণকে দেখে অনুপ্রাণিত হয়েছি।’
প্রতিযোগীদের মধ্যে পুরস্কারের মেডেল ও নগদ অর্থ প্রদান অনুষ্ঠানে সংগঠনের অ্যাডমিন মনজুর আহমেদের সঞ্চালনায় বক্তব্য দেন জেলা প্রশাসক এম কাজী এমদাদুল ইসলাম, বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের পরিচালক এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শফিউল আলম চৌধুরী, সিলেট সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক এইচ এম জহির। অনুষ্ঠানে সংগঠনের পক্ষ থেকে ধন্যবাদ জানিয়ে বক্তব্য দেন ইফতি সিদ্দিক ও অর্কাতুল জান্নাত।
বক্তারা বলেন, তরুণ সমাজের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে এবং মাদক থেকে দূরে রাখতে এমন আয়োজন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। ম্যারাথন বাংলাদেশে সেই অর্থে প্রচলিত না হলেও প্রতিযোগীরা যেভাবে উৎসাহের সঙ্গে অংশ নিয়েছেন, তা একটি ইতিবাচক ঘটনা। বাংলাদেশকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য এ ধরনের উদ্যোগ আসলেই প্রশংসনীয়।
আয়োজক সংগঠনের অ্যাডমিন মো. আলী কামাল বলেন, ‘পরবর্তী ম্যারাথনগুলোয় যেন আরও বেশি প্রতিযোগী অংশ নিতে পারেন, সে ব্যাপারে আমাদের প্রচেষ্টা থাকবে।’