তাঁরা ফিরে দেখলেন, বাড়িঘরের কিছুই অবশিষ্ট নেই
দেড় বছর পর নিজেদের ভিটায় ফিরলেন তাঁরা। কিন্তু বাড়িঘরের তেমন কিছুই অবশিষ্ট নেই। ঘরগুলো ভাঙাচোরা, জরাজীর্ণ। ভেতরে গজিয়েছে লতাপাতা। কিছু পাকা দালান মাটির সঙ্গে মিশে গেছে। বাড়ির চারপাশের বড় গাছগুলো হাওয়া হয়ে গেছে। যত দূর চোখ যায়, শুধু জঙ্গল আর জঙ্গল।
এ চিত্র কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার চাপড়া ইউনিয়নের পাহাড়পুর গ্রামে। অথচ দেড় বছর আগেও এখানে মানুষের কোলাহল ছিল। কাঁচা-পাকা অন্তত ৪৫টি বাড়ি ছিল। বাস করত শতাধিক মানুষ। অনেক দেরিতে হলেও প্রশাসনের সহায়তায় বাড়িগুলোতে প্রাণ ফিরতে শুরু করেছে। জঙ্গল কেটে পুনরায় আবাসস্থল গড়ার চেষ্টায় পরিবারগুলো। কেউ কেউ জরাজীর্ণ ঘরেই বসবাস শুরু করেছেন।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্র জানায়, আধিপত্য বিস্তার, সমাজপতিদের দলাদলি ও উসকানি বাড়াবাড়ি পর্যায়ে চলে গিয়েছিল। এর ধারাবাহিকতায় ২০২০ সালের ৩১ মার্চ ক্রিকেট খেলাকে কেন্দ্র করে নেহেদ আলী (৬৫) ও বকুল আলী (৫৫) নামের দুই ভাইকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় নেহেদ আলীর ছেলে নুরুল ইসলাম বাদী হয়ে ২৮ জনকে আসামি করে কুমারখালী থানায় মামলা করেন। এরপর গ্রেপ্তারের ভয় ও হামলার আশঙ্কায় পালিয়ে যায় অর্ধশতাধিক পরিবার।
ভুক্তভোগী পরিবারগুলোর দাবি, প্রতিপক্ষ তাদের বাড়িতে ভাঙচুর ও লুটপাট করেছিল। শুধু তা–ই নয়, দিনে দিনে ভাঙা ঘরের ইট, কাঠ ও মাটি পর্যন্ত লুট করা হয়। এ ছাড়া বাগানসহ গাছ ও বাঁশগুলো কেটে নেওয়া হয়। এ জন্য তাঁরা চলে গিয়েছিলেন।
কিন্তু প্রতিপক্ষের লোকজনের দাবি, ঘটনার পর তিন মাস এলাকায় পুলিশ ছিল। কে বা কারা এ জঘন্য কাজ করেছে, তা তাঁদের জানা নেই।
প্রশাসনের সহায়তায় দেড় বছর পর বাড়িতে ফিরতে শুরু করেছে ভুক্তভোগী পরিবারগুলো। মঙ্গলবার সেখানে তারা ভাঙাচোরা বাড়িঘর মেরামতের কাজ শুরু করেছে।
বাড়িতে ফেরার পর পাহাড়পুর গ্রামের মৃত হেকমতের ছেলে আলমগীর হোসেন বলেন, তিনি একটি বেসরকারি সংস্থায় চাকরি করতেন। ঘটনার দিন তিনি কর্মস্থল থেকে জানতে পারেন, এলাকায় জোড়া খুন হয়েছে। সেই খুনের মামলায় তাঁকে আসামি করা হয়। তিনি বাড়িঘর ছেড়ে চলে যান। পরে পরিবারের সদস্যরাও তাঁর কাছে চলে যান। সেই সুযোগে প্রতিপক্ষের লোকজন পাকা-কাঁচা ঘরবাড়ি ভাঙচুর করেন। শতাধিক মেহগনিগাছ কেটে নিয়ে যান।
ওই গ্রামের রুস্তম আলী শেখের স্ত্রী আলেয়া খাতুন বলেন, হত্যাকাণ্ডের পর তিনি পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ঢাকায় চলে যান। এখন প্রশাসনের সহযোগিতায় বাড়িতে ফিরেছেন। ঘরবাড়ি, আসবাব—কিছুই বাড়িতে নেই। তবু নতুন করে বসবাস শুরু করতে চান তিনি।
ভুক্তভোগীরা বলছেন, তুচ্ছ ঘটনায় এলাকায় যা ঘটেছে, তা দুঃখজনক। প্রকৃত দোষীদের বিচার হোক। কিন্তু যাঁরা নিরপরাধ, নির্দোষ; তাঁরা কেন মামলার আসামি হবেন।
ভুক্তভোগী আবদুর রহমান বলেন, ‘আমি একজন কৃষক। আট বিঘা জমিতে চাষাবাদ করি। আমি মামলার আসামি নই, তবু আমার ঘরবাড়ি ভাঙা হয়েছে। নতুন করে নির্মাণকাজ শুরু করেছি।’
বুধবার সকালে গিয়ে দেখা যায়, আগাছায় ভরা বাড়িঘরগুলোর ভগ্নাবশেষ পড়ে আছে। ফিরে আসা পরিবারগুলোর সদস্যরা কেউ কেউ বাড়ির আঙিনায় কীটনাশক ছিটাচ্ছেন। কেউ বাঁশ কাটছেন। কেউ জরাজীর্ণ ঘরের পাশেই ঘর তৈরি করছেন। কেউ কেউ কুঁড়েঘর বানাচ্ছেন। পুলিশের টহলগাড়ির পাশাপাশি দুজন পুলিশ সদস্যকে সেখানে বসে থাকতে দেখা যায়।
জোড়া খুনের মামলার বাদী নুরুল ইসলাম বলেন, ‘আমার পরিবার শোকাহত। আমরা কারও বাড়িঘর ভাঙিনি। লুটপাটও করিনি। ঘটনার পর প্রায় তিন মাস এলাকায় পুলিশ ছিল।’
কুমারখালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কামরুজ্জামান তালুকদার বলেন, ‘আসামিরা জামিন নিয়ে গ্রামে ফিরেছেন। পুলিশ আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় কাজ করছে। ঘটনা দেড় বছর আগের। সে সময় আমি এখানে ছিলাম না। তাই আগে কী হয়েছে, তা জানা নেই। মিলেমিশে বসবাসের জন্য উভয় পক্ষকেই ডাকা হয়েছে।’