‘ঘাস বেচিয়া কিছু লাভ অইলে অইলো (হলে হলো)। আসলে গরুর বাজারও তো আইতামই (আসতামই)। বাজার দেখা অইলো (হলো), বাজারও আওয়া-যাওয়ার (আসা-যাওয়ার) খরচও উঠল।’
হাসিমুখেই কথাগুলো বলেন আবদুল হাসিম (২০)। কথা বলার ধরনে মনে হয়নি এই ঘাসে তাঁর বিনিয়োগ আছে। লাভ-লোকসান নিয়ে তাঁর কোনো উদ্বেগ আছে।
হাসিমের বাড়ি মৌলভীবাজার সদর উপজেলার নাজিরাবাদ ইউনিয়নের জাকান্দিতে। পেশায় রাজমিস্ত্রি। কিন্তু বছরে একবার তিনি শখের ব্যবসায়ী, ঘাস বিক্রেতা। কোরবানির হাটে গবাদিপশুর ক্রেতা-বিক্রেতার কাছে তিনি ঘাস বিক্রি করেন। এটা তাঁর একটি আনন্দের অংশ। মৌলভীবাজার স্টেডিয়াম এলাকায় কোরবানির গবাদিপশুর হাটে বিক্রির জন্য ঘাস নিয়ে এসেছেন তিনি।
গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার দিকে মৌলভীবাজার স্টেডিয়াম এলাকায় গবাদিপশুর হাটে তাঁর সঙ্গে দেখা। রাস্তার এক পাশে আরও কয়েকজনের সঙ্গে ঘাস নিয়ে বসে ছিলেন তিনি। হাসিম বলেন, তিন বছর ধরে তিনি মৌলভীবাজার স্টেডিয়ামে কোরবানির গবাদিপশুর হাটে ঘাস নিয়ে আসেন। বছরে একবারই তিনি ঘাসের ব্যবসা করেন। এক মৌসুমের ব্যবসায়ী। এতে কিছু লাভ হলে ভালো। ঈদে কিছু বাড়তি টাকা আসে। লাভ না হলেও তাঁর কোনো আফসোস নেই। তবে সেদিন (বৃহস্পতিবার) হাটে গবাদিপশুর সংখ্যা কম ছিল। ক্রেতাদের উপস্থিতিও ছিল কম। তাই ঘাস বিক্রি তাঁর ধারণার চেয়ে কম হয়েছে। তারপরও প্রায় ১ হাজার ২০০ টাকার ঘাস বিক্রি করেছেন। খরচ পুষিয়ে যাবে, সে রকমই আশা তাঁর। আজ শনিবার ঈদবাজারের শেষ দিন পর্যন্ত গবাদিপশুর হাটে তাঁর এই ঘাস বিক্রি চলবে। গরুর বাজার দেখাও চলবে। প্রতি আঁটি ঘাস ৩০ থেকে ৪০ টাকায় বিক্রি করছেন। জাকান্দির কয়েছ মিয়াও একই রকম বছরে একবার ঈদ মৌসুমের ঘাস ব্যবসায়ী। তিনিও আর পাঁচ-সাতজনের মতো ঘাসের পসরা সাজিয়েছেন।
শুধু ঘাসই নয়, কোরবানির গবাদিপশুর হাটকেন্দ্রিক আরও নানা পণ্য নিয়ে এসেছেন অনেকে। তাঁরা কেউই এসব পণ্যের স্থায়ী ব্যবসায়ী নন। সব সময় এ পণ্যের সমান চাহিদাও থাকে না। তাঁদের প্রত্যেকেরই নানা রকম পেশা আছে। শুধু বছরে এই একবারই তাঁরা ব্যবসায়ী হন। গবাদিপশুর হাট শেষ, তাঁদের ব্যবসাও শেষ। আর এক বছরের অপেক্ষা। তাঁদের কেউ কাঠমিস্ত্রি, কেউ স মিলের (কাঠ চেরাই কল) শ্রমিক, কেউ রাজমিস্ত্রি, কারও আছে অন্য কোনো কাজ। কেউ কোরবানির দিনে মাংস রেখে কাটার জন্য ‘গদা’ বা কাঠের টুকরা নিয়ে এসেছেন। স্টেডিয়ামে ঢোকার আগে ওয়াপদা সড়কের এক পাশে ছোট–বড় অনেক গদা নিয়ে বসে ছিলেন বিক্রেতারা।
শহরতলির কালেঙ্গা থেকে গদা নিয়ে আসা আবদুল্লাহ (৪৮) প্রথম আলোকে বলেন, ‘পাঁচ বছর ধরে কোরবানির সময় গদা বেচি। আগে গাছ কিনি। তারপর টুকরা করে নিয়ে আসি।’ আবদুল্লাহ একটি স মিলে কাজ করেন। শুধু কোরবানির গবাদিপশুর হাটের সময় তিনি ব্যবসায়ী হয়ে ওঠেন। এবারও পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে একটি তেঁতুলগাছ কিনেছিলেন। সেটিকে ছোট–বড় প্রায় ৭০ টুকরা করে নিয়ে এসেছেন। প্রতিটি টুকরার দাম আকারভেদে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা।
মতিন মিয়া (২৫) অন্য সময় কাঠমিস্ত্রির কাজ করেন। তিনি বলেন, ‘ভালোই বিক্রি অইবো (হবে)।’ তিনিও সাত হাজার টাকা দিয়ে একটি তেঁতুলগাছ কিনে অনেকগুলো গদা তৈরি করেছেন। আকার অনুযায়ী ১০০ থেকে ৩০০ টাকা এক টুকরা গদার দাম।
গবাদিপশুর হাটলাগোয়া স্থানে ছুরি-চাকুর একটি অস্থায়ী দোকান। টেবিলের ওপর বিভিন্ন আকার ও ধরনের ছুরি সাজানো। কোরবানির হাটে আসা ক্রেতারা ছুরি-চাকু দেখছেন। দরদাম করছেন। কেউ দু–একটা কিনেও নিচ্ছেন। কোরবানির দিনে গরু-ছাগলের মাংস কাটতে এগুলো লাগবে তাঁদের। ছোট–বড় আকারের একেকটি ছুরির দাম ৫০ থেকে ২০০ টাকা। চাপাতি ৪০০ থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা। বিক্রেতা দামের ফারাকটা বোঝাতে ছুরির মান ও তারতম্য ক্রেতাদের বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন।
ব্যবসায়ী জাহাঙ্গীর আহমদ বলেন, ‘আমরার স্থায়ী দোকান আছে। তবে বছরে একবারই এখানো (স্টেডিয়াম এলাকা) লইয়া আই (নিয়ে আসি)। ঈদের সময়ই এগুলো বেশি বিকে (বিক্রি হয়)।’ এর বাইরেও মাংস বহনের বিভিন্ন ধরন ও আকারের ব্যাগ, মাংস কাটার জন্য বস্তার তৈরি চাটাই—এসব নিয়ে বসেছেন মৌসুমি বিক্রেতারা। তাঁরা সারা বছর অন্য কোনো পেশাতেই জীবন-জীবিকার পথে হাঁটেন। শুধু এই কোরবানির হাটে একবার তাঁরা মৌসুমি ‘ব্যবসায়ী’ হয়ে ওঠেন।