চলতি মাসের শুরু থেকে খুলনা মহানগরে করোনা চিকিৎসা দেওয়া হাসপাতালগুলোতে মৃত্যুর সংখ্যা অনেকটা কমে এসেছিল। কবে সেটি শূন্যের কোঠায় নেমে আসবে, সে প্রহরই গুনছিলেন সবাই। অবশেষে তিন মাস পর সেই ক্ষণের দেখা মিলেছে। গতকাল রোববার সকাল ৮টা থেকে আজ সোমবার সকাল ৮টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় নগরের পাঁচটি করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতালে কোনো ব্যক্তির মৃত্যু হয়নি। এর আগে সর্বশেষ গত ২৫ মে খুলনায় মৃত্যুর সংখ্যা শূন্য ছিল।
খুলনা মহানগরে মোট পাঁচটি হাসপাতালে করোনার চিকিৎসা দেওয়া হয়, এর মধ্যে দুটি বেসরকারি হাসপাতাল। জুলাইয়ে ওই হাসপাতালগুলোতে প্রতিদিনই ৫ থেকে ১৫ জন পর্যন্ত করোনা রোগী মারা যাচ্ছিলেন। আগস্টের শুরু থেকে মৃত্যুর সংখ্যা কমে আসতে থাকে। সেই সঙ্গে কমতে থাকে শনাক্তের হারও। গত ২৫ দিন খুলনায় মৃত্যুর সংখ্যা দুই অঙ্কের নিচে রয়েছে।
খুলনা জেলায় করোনায় মৃত্যু ও শনাক্ত কমেছে
খুলনা জেলায় একদিকে যেমন করোনায় আক্রান্ত রোগীর মৃত্যু কমেছে, অন্যদিকে কমেছে শনাক্তও। তা ছাড়া হাসপাতালগুলোতেও কমেছে রোগীর চাপ। সব মিলিয়ে করোনা পরিস্থিতি কিছুটা উন্নতির দিকে যাচ্ছে। ফলে স্বস্তি ফিরছে সাধারণ মানুষ, চিকিৎসক ও হাসপাতালসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে ঈদুল আজহার আগে খুলনা মহানগর ও জেলায় দেওয়া বিশেষ বিধিনিষেধের সুফল পাওয়া যাচ্ছে। জুনের শেষ ও পুরো জুলাই মাসে করোনা খুলনা জেলায় যে তাণ্ডব চালিয়েছে, এখন তার অর্ধেকও নেই। চোখের সামনে নিজের আত্মীয়স্বজনদের মারা যেতে দেখে মানুষও আগের চেয়ে বেশি সচেতন হয়েছেন। এসব কারণেই খুলনায় মৃত্যু ও শনাক্তের হার কমে এসেছে।
পুরো জুলাইয়ে খুলনায় মারা যান ৩৬৯ জন। অন্যদিকে আগস্টের শুরু থেকে ২২ তারিখ পর্যন্ত খুলনায় মারা গেছেন মাত্র ১১৭ জন।
খুলনা সিভিল সার্জন ও বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালকের কার্যালয় থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যাচ্ছে, ৩০ জুন পর্যন্ত খুলনা জেলায় করোনায় আক্রান্ত মৃত ব্যক্তির সংখ্যা ছিল ২৫৭ । ১ জুলাই জেলায় আটজন করোনা রোগী মারা যান। ওই দিন করোনায় মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়ায় ২৬৫। আর পুরো জুলাইয়ে খুলনায় মারা যান ৩৬৯ জন। অন্যদিকে আগস্টের শুরু থেকে ২২ তারিখ পর্যন্ত খুলনায় মারা গেছেন মাত্র ১১৭ জন। জুলাইয়ের প্রথম দিকে করোনার উপসর্গ নিয়ে মানুষের মৃত্যুর সংখ্যাও অনেক বেশি ছিল। প্রতিদিনই ৫ থেকে ১০ জন উপসর্গ নিয়ে মারা যাচ্ছিলেন। বর্তমানে ওই সংখ্যা প্রায় শূন্য।
করোনাভাইরাস সংক্রমণের হিসাব পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ১ জুলাই সংক্রমণ ছিল ৩৮ শতাংশ। আর পরদিন সংক্রমণ ছিল ৪৫ শতাংশ। ১২ জুলাই সংক্রমণ ছিল ৩৯ শতাংশ। একইভাবে ১ আগস্ট সংক্রমণ কমে দাঁড়িয়েছিল ২৪ শতাংশে ও পরদিন ২০ শতাংশে। সর্বশেষ গত ২৪ ঘণ্টায় শনাক্ত হয়েছে মাত্র ১৩ শতাংশ।
চলতি বছরের মে মাসের শুরুর দিক থেকে খুলনায় করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউয়ের প্রভাব পড়া শুরু হয়। হাসপাতালে বাড়তে থাকে রোগীর সংখ্যাও। মারা যাওয়ার হারও ছিল বেশি। এমন পরিস্থিতিতে গত ২২ জুন থেকে করোনাভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধে খুলনা জেলা ও মহানগর এলাকায় বিধিনিষেধ ঘোষণা করা হয়। প্রথম দফায় ২৮ জুন রাত ১২টা পর্যন্ত চলে ওই বিধিনিষেধ। পরে বিধিনিষেধের মেয়াদ আরও এক সপ্তাহ বাড়িয়ে করা হয় ৫ জুলাই পর্যন্ত।
খুলনায় করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু যেমন কমেছে, তেমনি কমেছে সংক্রমণও। এটা আসলে ঈদের আগে জারি করা বিশেষ ‘লকডাউনের’ প্রভাব। তা ছাড়া টিকা গ্রহণ, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা, মাস্ক ব্যবহারে উৎসাহী হওয়াসহ বিভিন্ন কারণে পরিস্থিতি অনেকটা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে চলে এসেছে।
খুলনা সিভিল সার্জন নিয়াজ মোহাম্মদ প্রথম আলোকে বলেন, খুলনায় করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু যেমন কমেছে, তেমনি কমেছে সংক্রমণও। এটা আসলে ঈদের আগে জারি করা বিশেষ ‘লকডাউনের’ প্রভাব। তা ছাড়া টিকা গ্রহণ, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা, মাস্ক ব্যবহারে উৎসাহী হওয়াসহ বিভিন্ন কারণে পরিস্থিতি অনেকটা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে চলে এসেছে। সব মিলিয়ে বর্তমানে কিছুটা স্বস্তির মধ্যে আছেন সবাই। তবে সচেতন না হলে পরিস্থিতি আবারও খারাপের দিকে যেতে পারে বলে মনে করেন তিনি।
জুনে করোনা সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় একদিকে যেমন বাড়ানো হয় শয্যাসংখ্যা, অন্যদিকে নতুন নতুন হাসপাতালকে যুক্ত করা হয় করোনা চিকিৎসায়। আগে খুলনায় শুধু করোনা চিকিৎসা দেওয়া হতো খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিচতলায় অবস্থিত ১০০ শয্যার ডেডিকেটেড করোনা হাসপাতালে। রোগী বাড়তে থাকায় ওই হাসপাতালে শয্যাসংখ্যা বাড়িয়ে করা হয় ১৩০টি। রোগীর চাপ সামলাতে পরে আরও ৭০টি শয্যা বাড়িয়ে সেখানে শয্যা করা হয় ২০০টি। জুলাইয়ে ওই হাসপাতালে প্রতিদিনই ১৯০ থেকে ২০০–এর বেশি রোগী ভর্তি ছিল।
ওই হাসপাতালে রোগীর চাপ কমাতে জুনের শেষের দিকে ২৫০ শয্যার সদর (জেনারেল) হাসপাতালে সাধারণ রোগীদের ভর্তি বাতিল করে ৮০ শয্যার করোনা হাসপাতাল করা হয়। অন্যদিকে শহীদ শেখ আবু নাসের বিশেষায়িত হাসপাতালে চালু করা হয় ৪৫ শয্যার করোনা ইউনিট। এর মধ্যে ছিল ১০টি আইসিইউ শয্যা। আগে শুধু বেসরকারি গাজী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে করোনা চিকিৎসা দেওয়া হতো। জুন পর্যন্তও ওই হাসপাতালে ছিল ৭০টি করোনা শয্যা। পরে প্রথম দফায় ৩০টি ও পরবর্তী সময়ে আরও ৫০টি শয্যা বাড়িয়ে করোনা রোগীদের জন্য শয্যা করা হয় ১৫০টি। জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহ থেকে ৯০টি শয্যা নিয়ে বেসরকারি সিটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেও চালু হয় করোনা ইউনিট।
হাসপাতালগুলোর ভর্তিসংক্রান্ত তথ্য থেকে দেখা গেছে, আজ সোমবার ২০০ শয্যার ডেডিকেটেড করোনা হাসপাতালে ৭১ জন, ৪৫ শয্যার শহীদ শেখ আবু নাসের বিশেষায়িত হাসপাতালে ২৫ জন, ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট সদর হাসপাতালে (৮০ শয্যার করোনা ইউনিট) মাত্র ৬ জন, ১৫০ শয্যার বেসরকারি গাজী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১৪ জন ও ৯০ শয্যার বেসরকারি সিটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৩৭ জন ভর্তি রয়েছেন। তবে সরকারি দুটি হাসপাতালে থাকা ৩০ আইসিইউ শয্যার কোনোটিই খালি পড়ে থাকছে না।
খুলনা জেলা করোনাভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধ কমিটির অন্যতম সদস্য ও খুলনা মেডিকেল কলেজের উপাধ্যক্ষ মেহেদী নেওয়াজ বলেন, খুলনায় সবার ঐকান্তিক প্রচেষ্টার কিছু সুফল পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু মানুষ যদি সচেতন না হয়, স্বাস্থ্যবিধি মেনে না চলে, তাহলে আবারও সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।