‘তেল কিনলে মরিচ নিতাম পারি না, ঈদ লইয়া ভাবতাম কিতা’

ভাসমান শ্রমিকহাটে কাজের অপেক্ষায় দিনমজুরেরা। গতকাল শুক্রবার সকাল সাড়ে আটটার দিকে মৌলভীবাজার শহরের চৌমোহনা চত্বরেছবি: প্রথম আলো

ভাসমান শ্রমিকহাটের তখন ভাঙা অবস্থা। ভিড়ভাট্টা কমে গেছে। বিচ্ছিন্নভাবে নানা বয়সের অর্ধশতাধিক শ্রমিক টুকরি-কোদাল নিয়ে কাজ পাওয়ার অপেক্ষায় এদিক-ওদিক বসে আছেন। কেউবা দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছেন। কাজ মিললে বাজার করে বাড়ি ফেরা যাবে, না হলে ফিরতে হবে খালি হাতে।

কিছুক্ষণ আগেও স্থানটিতে ছিল দুই শতাধিক মানুষের কোলাহল। হাঁকডাক ছিল। তাঁদের একটি বড় অংশ ততক্ষণে কাজ পেয়ে বিভিন্ন দিকে চলে গেছেন। যাঁরা কাজ পাননি, তাঁদের অপেক্ষা পরের দিনের।

গতকাল শুক্রবার সকাল সাড়ে আটটার দিকে মৌলভীবাজার শহরের চৌমোহনা চত্বরের ভাসমান শ্রমিকহাটের দৃশ্য এটি। এসব মানুষের কাছে উৎসব-পার্বণ আসে দারিদ্র্যের কষ্ট আর বিড়ম্বনা নিয়ে। অভাব যাঁদের নিত্যসঙ্গী, উৎসবে নতুন জামা ও ভালো খাবার নিয়ে ভাবনার সুযোগ তাঁদের নেই।

স্থানীয় লোকজন জানিয়েছেন, চৌমোহনা চত্বরের ভাসমান শ্রমিকহাটে কয়েক বছর ধরে সকালবেলা শ্রমিকেরা ভিড় করেন। এত দিনে স্থানটি একটি অস্থায়ী শ্রমিকহাটের আদল পেয়ে গেছে। ভোর থেকে টুকরি-কোদাল কাঁধে ঝুলিয়ে শ্রমিকেরা এসে ভিড় করতে থাকেন। কি শীত, কি বর্ষা—শত শত শ্রমিকের কোলাহলে স্থানটি মুখর হয়ে ওঠে। এ কারণে সেখানে প্রায় প্রতিদিনই চার থেকে পাঁচটি ভ্রাম্যমাণ চা-পানের দোকানও বসে।

এই শ্রমিকেরা আসেন মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে। তাঁরা শহর ও শহরতলির বিভিন্ন স্থানে বাসা ভাড়া করে থাকেন। কেউ কেউ থাকেন সপরিবারে, কেউ কেউ একা। আবার কেউ কেউ আসেন বাড়ি থেকেই। সকাল সাতটা থেকে সাড়ে সাতটা পর্যন্ত শ্রমিকদের আনাগোনা চলে। কাজ পেলে ৫০০ থেকে ৮০০ টাকা রুজির ব্যবস্থা হয়, না হলে খালি হাতে ফিরতে হয় ঘরে।

গতকাল সকালে চৌমোহনা চত্বরে গিয়ে দেখা যায়, চত্বরের চারদিকে পাঁচ থেকে দশজনের জটলা করে অনেক শ্রমিক বসে আছেন। পাশে সারি করে রাখা টুকরি-কোদাল। একপর্যায়ে অনেক শ্রমিকই কাছে এসে ভিড় করেন। সবার মধ্যে কাজ পাওয়ার প্রত্যাশা। নানা বিষয়ে কথা বলছিলেন তাঁরা। ঘরে ছেলেমেয়ে, স্ত্রী, বাবা-মা ও ভাই-বোন আছেন। তাঁদের নতুন একটা জামাকাপড় কিনে দেওয়া তো দূরের কথা, ঈদের দিন ভালো কোনো আহারের ব্যবস্থা করাও কঠিন হয়ে গেছে। এ সময় একে একে সবাই অনুরোধ করেন, তাঁর নামটা যেন লিখে নেওয়া হয়।

শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কয়েক দিন ধরে কাজ কমে গেছে। তাই অনেককেই কাজ না পেয়ে ফিরে যেতে হচ্ছে। মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের জহির মিয়া বলেন, ‘এখানও যাঁরা আছেন, তাঁদের সবারই একই সমস্যা, টাকা নাই। যা রুজি করছি, তা দিয়া তেল কিনলে মরিচ নিতাম পারি না, ঈদ লইয়া (নিয়ে) ভাবতাম কিতা (কী)!’

ভ্রাম্যমাণ হাটে কাজের জন্য অপেক্ষা শ্রমিকদের
ছবি: প্রথম আলো

দুই মেয়ে জন্য এখনো ঈদের পোশাক কিনতে পারেননি রাজনগরের শাহীন মিয়া। তিনি বলেন, ‘মাইয়া দুইডারে জামা কিনা দিবার চিন্তা আছে। কিন্তু নিজর চিন্তা নিজর ভেতরে লইয়া বই রইছি (বসে রয়েছি)।’

একে একে আলাপ হয় ফজলু মিয়া, সবর মিয়া, আবদুল গফুর, জাকির মিয়া, লাল মিয়া, রকিব মিয়া, জহিরুল ইসলাম, হৃদয় মিয়া, আবুল মিয়া, আবু মিয়া, মিজান মিয়া, শাহীন মিয়া, আসাদ হোসেন, জসিম মিয়া, সাইদুল মিয়া, মো. আলী, জানু মিয়া, আবদুল্লাহসহ প্রায় ৩০ জন শ্রমিকের সঙ্গে।

হবিগঞ্জের চুনারুঘাটের সুমন মিয়া বলেন, ‘ভোর পাঁচ-ছয়টায় আই (আসি)। আটটা-নয়টার দিকে ফেরত যাই। আইজ (আজ) তিন-চাইর দিন (চার দিন) ধরি আইয়া (এসে) ঘোরাঘুরি করি ফিরত যাইরাম (যাচ্ছি)। কাজ নাই। পয়সা নাই। ছেলেমেয়েরে কই থাকি জামা কিনিয়া দিতাম (কোথা থেকে কিনি দিব)।’

তাঁদের মতো গরিবের ঈদের দিনও যা, অন্য দিনও তা বলে জানান ভাসমান শ্রমিক ওয়াহিদ মিয়া। তিনি বলেন, ‘অউযে দেখরা (এই যে দেখতেছেন), এরা কেউরিরই (এদের কারোই) টাকাপয়সা নাই, যা রুজি করে তা দিয়ে সংসারর খরচই চলে না।’

মোক্তার মিয়া বলেন, ‘জামা–পোশাক তো দূরর কতা, একটু ভালা খানিরই ব্যবস্থা করতাম পাররাম না। কোন জাগাত গেলে কিচ্ছু পাইমু, তাও জানি না।’