স্থানীয় ব্যক্তিদের ভাষ্য, সমাজের নানাজনের নানা অপপ্রচার ও প্রতিকূলতা মাড়িয়ে টানা ১৮ বছর সংগ্রাম করে টিকে আছেন ফাহমিদা। সন্তানদের জন্য নিজের সব সুখ বিসর্জন দিয়ে তিনি এখন এলাকায় ‘দৃষ্টান্ত’।
আজ রোববার মা দিবস। দিবসটি উপলক্ষে এই সংগ্রামী মায়ের সঙ্গে কথা বলেন প্রথম আলোর এই প্রতিবেদক।
ফাহমিদা বলেন, ‘১৯৯৬ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি কলেজশিক্ষক মিজানুরের সঙ্গে আমার বিয়ে হয়। তখন আমি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক। দাম্পত্য জীবনের আট বছরে ওই দুই সন্তানের জন্ম হয়। এর মধ্যে আমার স্বামী চাঁদপুরের কচুয়া উপজেলার গুলবাহার আশেক আলী খান স্কুল অ্যান্ড কলেজে অধ্যক্ষ পদে যোগ দেন। হঠাৎ তাঁর শরীরে ক্যানসার ধরা পড়ে। একপর্যায়ে তিনি মারা যান। তাঁর বিয়োগে আমার অবস্থা একেবারে নাজুক হয়ে পড়ে। অবুঝ দুই শিশুকে নিয়ে কী করব ভেবে পাচ্ছিলাম না। তখন আমি কুমিল্লার বরুড়া উপজেলার আড্ডা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক। আমার শ্বশুর বলেছিলেন গ্রামের বাড়ি ফিরে যেতে। আমার বাবা বললেন, কুমিল্লা শহরে চলে আসতে। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম স্কুলের কাছেই থাকব। নিজেদের মাথা গোঁজার একটু জায়গা আছে। সেখানে থেকে শিক্ষকতা করব। এরপর শুরু হলো নতুন সংগ্রামী জীবন।’
ফাহমিদা বলেন, ‘বাসায় টিউশনি শুরু করি। স্কুলের বেতনও পাচ্ছিলাম। এ নিয়ে টেনেটুনে চলে যাচ্ছিল। এরই মধ্যে নানাজনের নানা টিপ্পনী শুরু হয়। কেউ বিয়ের জন্য চাপ দেয়। কেউ অপপ্রচার করে আমার বিয়ে হয়ে গেছে। নীরবে সবকিছু সহ্য করেছি। সবকিছু মাড়িয়ে ছেলে দুটির পড়াশোনা চালিয়ে গেছি। তখন আমার শ্বশুর অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক নজির আহমেদ আমাকে ২০ শতাংশ জমি দিলেন ছেলেদের পড়াশোনার খরচ চালানোর জন্য। আমি টিউশনি আরও বাড়িয়ে দিলাম। কোনোভাবেই জমি বিক্রি করিনি। আমার বাসায় এসে বাচ্চারা পড়ত। কখনো কারও বাসায় গিয়ে পড়াইনি। স্বামী মারা যাওয়ার তিন বছরের মধ্যে আমার বাবা কাজী ছিদ্দিকুর রহমান মারা যান। ছয় বছরের মধ্যে শ্বশুরও মারা যান। স্বামীর পর দুই অভিভাবককে হারিয়ে আমি হতভম্ভ হয়ে পড়ি। এরপর মনে সাহস সঞ্চয় করি। ছেলেদের পড়াশোনা ব্যাহত করা যাবে না। এভাবে বড় ছেলে এসএসসি, এইচএসসি শেষ করে চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। এখন ছেলেটি চট্রগ্রামের পোর্ট সিটি ইন্টারন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সিএসই বিভাগের প্রভাষক। ছোট ছেলে সিএসইতে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। ২০১৮ সালের ২ জুলাই সহকারী শিক্ষক থেকে পদোন্নতি পেয়ে প্রধান শিক্ষক হই।’
কী ছিল এমন ওয়াদা? ফাহমিদা ছিদ্দিকা বলেন, ‘মৃত্যুর আগে আমার স্বামী বলেছিলেন, তোমাকে আমি কিছু দিতে পারিনি। তোমাকে দুটি রত্ন দিয়ে গেছি, তুমি ওদের যত্ন করো।’ তাঁর সেই কথা আমি রেখেছি।
ফাহমিদার বাবার বাড়ি কুমিল্লার বরুড়ার ভাউকসার গ্রামে। স্বামীর বাড়ি একই উপজেলার অশ্বদিয়া গ্রামে। বর্তমানে ফাহমিদা বরুড়ার নশরতপুর জুলফে আলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক।
মুহতাদীর রহমান বলেন, ‘মায়ের এমন আত্মত্যাগ কখনো ভুলব না। স্বপ্নপূরণে তিনি ছায়ার মতো পাশে আছেন। এমন মায়ের সন্তান হিসেবে গর্বিত আমি।’
তাহমিদুর রহমান বলেন, ‘বাবার কথা আমার মনে নেই। মা-ই আমার চালিকাশক্তি।’