দুই মাস ধরে একঘরে দম্পতি

পঞ্চগড় জেলার ম্যাপ

দিনমজুর আয়নাল হক ও জামিরন বেগমের ৩৫ বছরের সংসার। চার সন্তানের মধ্যে দুই মেয়ে ও এক ছেলেকে বিয়ে দিয়েছেন তাঁরা। গত ১৮ এপ্রিল আয়নাল ও জামিরনের মধ্যে পারিবারিক বিষয় নিয়ে ঝগড়া হয়। এ সময় রাগের মাথায় স্ত্রীকে তালাকের ঘোষণা দেন তিনি। বিষয়টি স্থানীয় গ্রাম্য মাতবরদের কানে পৌঁছাতেই শুরু হয় বিপত্তি। মাতবররা জামিরনকে হিল্লা বিয়ে দিতে বলেন। এতে রাজি না হওয়ায় প্রায় দুই মাস ধরে ওই দম্পতিকে তাঁরা একঘরে করে রেখেছেন।

একঘরে করে রাখায় গত জুন মাস থেকে আয়নাল হক ও জামিরন বেগম দুর্বিষহ জীবন যাপন করছেন। তাঁরা পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জ উপজেলার সুন্দরদিঘী ইউনিয়নের সলিমনগর এলাকার বাসিন্দা।

এভাবে একঘরে করে রাখায় গত জুন মাস থেকে আয়নাল হক ও জামিরন বেগম দুর্বিষহ জীবন যাপন করছেন। তাঁরা পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জ উপজেলার সুন্দরদিঘী ইউনিয়নের সলিমনগর এলাকার বাসিন্দা। এ ঘটনায় জামিরন বেগম গত সোমবার দেবীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) প্রত্যয় হাসানের কাছে একটি লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন।

বৃহস্পতিবার সকালে একঘরে করে রাখা ওই দম্পতির বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, সন্তানদের নিয়ে তাঁরা বাড়িতেই অবস্থান করছেন। একঘরে রাখায় তাঁরা দোকান বা বাজারে গিয়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে পারছেন না। আত্মীয়স্বজনের বাড়ি যাওয়া বন্ধ। এ কারণে ওই দম্পতি কোনো কাজও পাচ্ছেন না।

জামিরন বেগম বলেন, ‘গত ৫ রমজান (১৮ এপ্রিল) তারিখ পারিবারিক সমস্য নিয়ে স্বামী আয়নাল হকের সঙ্গে আমার ঝগড়া হয়েছিল। ওই দিন আমার স্বামী নাকি রাগের মাথায় তালাকের কথা বলেছিলেন। সেই কথা আমি শুনিনি। স্থানীয় লোকজন শুনেছেন। ঝগড়ার পর আমি রাগ করে একই গ্রামে আমার বড় ছেলের বাড়িতে চলে যাই। পরে গ্রামের লোকজন আমার স্বামীকে তালাক দেওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করে আমাদের তালাক হয়ে গেছে বলে জানায়।’

জামিরন বেগম আরও বলেন, ‘ছেলের বাড়িতে এক মাস থাকার পর আমি আবার বাড়িতে ফিরলে গ্রাম্য মাতবর মোস্তফা ইসলাম (৩০), শাহাজান আলী (৬০), আমির চাঁনসহ (৫৫)  কয়েকজন আমার স্বামীকে ডেকে আমাদের তালাক হয়েছে বলে জানান। এ পরিস্থিতিতে আমাকে অন্য কারও কাছে হিল্লা বিয়ে দিতে হবে বলে এক মুফতি জানান। পরে আমার স্বামী আমাকে হিল্লা বিয়ে দিতে রাজি না হওয়ায় প্রায় দুই মাস ধরে আমাদের একঘরে করে রেখেছেন তাঁরা। উপায় না পেয়ে আমি গত সোমবার ১০ জনের নামে ইউএনওর কাছে অভিযোগ দিয়েছি।’

একঘরে হয়ে থাকা আয়নাল হক বলেন, ‘আমি রাগের মাথায় আমার স্ত্রীকে তালাকের কথা বলেছি সত্য। তবে আমি বিভিন্ন আলেমের কাছে জেনেছি, এভাবে স্ত্রী তালাক হয়ে যায় না। এ জন্য আমরা এক মাস পর একসঙ্গে থাকতে শুরু করি। কিন্তু স্থানীয় শাহজাহান আলী, মুফতি আনোয়ার, মোস্তফা ইসলাম, আমির চাঁনসহ প্রায় ১০ জন আমার স্ত্রীকে তিন মাসের জন্য অন্য এক ব্যক্তির কাছে হিল্লা বিয়ে দিতে চাপ দেন। পরে আমি রাজি না হওয়ায় আমাদের একঘরে করে রাখেন। এখন আমরা গ্রামের কারও সঙ্গে কথা বলতে পারি না। কেউ কাজেও নেয় না। অভাবে দিন কাটাচ্ছি। স্থানীয় কোনো দোকানদার আমাদের কাছে পণ্য বিক্রি করে না।’

ওই দম্পতিকে একঘরে রাখার বিষয়ে গ্রাম্য মাতবর শাহজাহান আলী বলেন, আয়নাল তাঁর স্ত্রীকে তালাক দিয়েছেন, এ কথা তিনি নিজেই তাঁদের কাছে এসে বলেছেন। এমনকি তিনি ওই স্ত্রীকে গ্রহণ করবেন না বলে তাঁদের জানিয়েছিলেন। পরে তাঁরা একজন মুফতিকে ডেকে পরামর্শ নেন। তিনি তাঁদের জানিয়েছেন ওই দম্পতির বিবাহবিচ্ছেদ (তালাক) হয়ে গেছে। তবে হিল্লা দিতে চাপ দেওয়ার কথা কৌশলে এড়িয়ে গিয়ে শাহজাহান আলী বলেন, ‘সমাজের কথা না শোনায় ওই দম্পতিকে সমাজ থেকে আলাদা করা হয়েছে। ওরা ওদের মতো করে চলবে আর আমরা আমাদের মতো করে চলব।’

সুন্দরদিঘী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান পরেশ চন্দ্র রায় বলেন, ‘গত সোমবার আয়নাল হকের স্ত্রী জামিরন বেগম ইউএনওর কাছে এ বিষয়ে অভিযোগ দিয়েছেন। পরে ইউএনও আমাকে বিষয়টি দেখতে বলেন। এর মধ্যে ত্রাণ বিতরণের কাজ থাকায় আমরা আলোচনায় বসতে পারিনি।’

এ বিষয়ে পঞ্চগড় জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি ও সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) আমিনুর রহমান বলেন, ‘রাগের মাথায় তালাক বললে তা কখনোই কার্যকর হয় না। এ বিষয়ে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা আছে। ওই নির্দেশনা অনুযায়ী কেউ রাগের মাথায় স্ত্রীকে তালাক বলে আবারও একত্রে সংসার করতে তাঁকে (স্ত্রীকে) হিল্লা বিয়ের জন্য কোনো ব্যক্তি চাপ প্রয়োগ করে ফতোয়া দিলে ফতোয়াদাতার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ আছে।’

পঞ্চগড় জেলা মুসলিম নিকাহ রেজিস্টার সমিতির সভাপতি আবদুর রহমান বলেন, ইসলামি শরিয়ত অনুযায়ী কোনো ব্যক্তি তাঁর স্ত্রীকে মৌখিক তালাক দেওয়ার পর তিন মাস একত্রে না থাকলে তা কার্যকর হয়ে যায়। আর এ তিন মাসের মধ্যে তাঁরা যদি আবারও সংসার করতে চান, তাহলে তাতে কোনো আপত্তি থাকে না। এতে হিল্লা বিয়ের কোনো প্রয়োজন নেই।

বৃহস্পতিবার দুপুরে ওই এলাকায় গিয়ে বিষয়টি সমাধান করা হয়েছে। তবে যাঁরা এত দিন ভুল সিদ্ধান্ত দিয়ে ওই দম্পতিকে দুর্ভোগে ফেলেছিলেন, তাঁদের বিরুদ্ধে তদন্ত সাপেক্ষে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
প্রত্যয় হাসান, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, দেবীগঞ্জ, পঞ্চগড়

বৃহস্পতিবার বিকেলে দেবীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) প্রত্যয় হাসান বলেন, বৃহস্পতিবার দুপুরে ওই এলাকায় গিয়ে বিষয়টি সমাধান করা হয়েছে। তবে যাঁরা এত দিন ভুল সিদ্ধান্ত দিয়ে ওই দম্পতিকে দুর্ভোগে ফেলেছিলেন, তাঁদের বিরুদ্ধে তদন্ত সাপেক্ষে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।