পিরোজপুরের এহসান গ্রুপ
দুশ্চিন্তায় হাজারো গ্রাহক
গ্রাহকদের বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান ও তাঁর তিন ভাই গ্রেপ্তার।
আলোচিত এহসান গ্রুপে ৯ লাখ টাকা আমানত রেখেছিলেন মাদ্রাসাশিক্ষক আখতারুজ্জামান। প্রতিষ্ঠানটি আমানতের টাকা ও লভ্যাংশ দেওয়া বন্ধ করে দিলে তিনি ধরনা দেন কর্তৃপক্ষের কাছে। এর মাধ্যমে ৬০ হাজার টাকা ফেরত পান। এহসান গ্রুপের চেয়ারম্যান রাগীব আহসান গ্রেপ্তার হওয়ায় বাকি টাকা ফেরত পাবেন কি না, তা নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েছেন আখতারুজ্জামান।
প্রতারণা ও জালিয়াতির মাধ্যমে গ্রাহকদের বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে রাগীব আহসান ও তাঁর তিন ভাই গ্রেপ্তার হন ৯ সেপ্টেম্বর। এর পর থেকে দুশ্চিন্তায় আছেন আখতারুজ্জামানসহ পিরোজপুরের হাজারো গ্রাহক। তাঁদের মধ্যে অন্তত ২৫ জনের সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়েছে।
পিরোজপুর পৌরসভার ব্রাহ্মণকাঠি মহল্লার অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক আলী আকবর বলেন, ‘আমি এহসান গ্রুপের কর্মী ছিলাম। ৫৮০ জন গ্রাহক আমার মাধ্যমে ২ কোটি ২৫ লাখ টাকা আমানত রাখেন। কয়েক বছর গ্রাহকদের লভ্যাংশ নিয়মিত দেওয়া হয়। দুই বছর আগে প্রতিষ্ঠানটি কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়। এর পর থেকে গ্রাহকেরা টাকা ফেরত পেতে আমাকে চাপ দিয়ে আসছেন। সম্প্রতি রাগীব হাসান গ্রেপ্তারের পর গ্রাহকের টাকা ফেরতের কোনো উদ্যোগ প্রশাসন না নেওয়ায় আমি হতাশ।’
গ্রাহকদের টাকা ফেরত দেওয়ার ব্যাপারে আমাদের কোনো উদ্যোগ নেওয়ার সুযোগ নেই।আবু আলী মো. সাজ্জাদ হোসেন, জেলা প্রশাসক, পিরোজপুর
জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, এহসান গ্রুপের বিরুদ্ধে পিরোজপুরে প্রথম অভিযোগ ওঠে ২০১৯ সালের আগস্টে। ওই সময়ে জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির মাসিক সভায় প্রসঙ্গটি তোলা হয়। এরপর অভিযোগ তদন্তে একটি কমিটি গঠন করা হয়। পিরোজপুর সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আসিফ মাহমুদ কমিটির প্রধান হন। সেই কমিটি তখন জেলা প্রশাসকের কাছে একটি প্রতিবেদন জমা দেয়। এরপর জেলা প্রশাসন এহসান গ্রুপের সম্পদের হিসাব নেয়, তবে এহসান গ্রুপের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা বা আমানতকারীদের টাকা ফেরতের কোনো উদ্যোগ নেয়নি প্রশাসন।
কাউখালী উপজেলার চিড়াপাড়া গ্রামের নাসির উদ্দিন বলেন, ১০ হাজার গ্রাহকের শতকোটি টাকা এহসান গ্রুপের কাছে আমানত রয়েছে। অনেক গ্রাহক আছেন, যাঁরা নিজেদের সব পুঁজি এ প্রতিষ্ঠানে জমা রেখেছেন। আমানতের টাকার লভ্যাংশ দিয়ে অনেকের সংসার ও চিকিৎসা চলত। দুই বছর ধরে লভ্যাংশ ও আমানতের টাকা ফেরত দেওয়া বন্ধ রয়েছে। এ কারণে পরিবারগুলো নিঃস্ব হয়ে পড়েছে। এখন রাগীব গ্রেপ্তার হয়েছেন। টাকা ফেরত দেওয়ার জন্য প্রশাসনের হস্তক্ষেপ দেখতে চান তাঁরা।
* ২০০৮ সালে পিরোজপুরে এহসান গ্রুপ ব্যবসা শুরু করে। * ২০১৯ সালের জুলাই থেকে প্রতিষ্ঠানটি গ্রাহকদের মাসিক মুনাফা ও আমানতের টাকা ফেরত দেওয়া বন্ধ করে দেয়।
আমানতকারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০০৮ সালে পিরোজপুরে এহসান গ্রুপ চারটি সমবায় সমিতি ও এহসান রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড বিল্ডার্স লিমিটেড নামে ব্যবসা শুরু করে। তখন সুদবিহীন বিনিয়োগ ও অধিক মুনাফা দেওয়ার কথা বলে সঞ্চয় আমানত নিতে শুরু করে তারা। গ্রাহকের টাকায় সঞ্চয় ও ঋণদান, অবৈধ ক্যাডেট একাডেমি, কোটি কোটি টাকার আবাসন ব্যবসা, তৈরি পোশাক ও প্রসাধনসামগ্রীর ব্যবসা, স্যানিটারি, হার্ডওয়্যার সামগ্রীর ব্যবসাসহ ১৭টি প্রতিষ্ঠান করেছিল। তবে বর্তমানে বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব নেই। পিরোজপুরের পাশাপাশি ঝালকাঠি ও বাগেরহাট জেলার অনেক মানুষ এহসান গ্রুপে টাকা আমানত রাখেন। ২০১৯ সালের জুলাই থেকে প্রতিষ্ঠানটি গ্রাহকদের মাসিক মুনাফা ও আমানতের টাকা ফেরত দেওয়া বন্ধ করে দেয়। অন্যদিকে গ্রাহকদের বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিয়ে রাগীব আহসান নামে-বেনামে সম্পত্তি ও জায়গাজমি কেনেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
এহসান গ্রুপে টাকা আমানত রেখে পথে বসা ব্যক্তিদের একজন নাজিরপুর উপজেলার কবিরাজবাড়ি গ্রামের জাহানারা বেগম (৩৫)। তিনি স্বামীকে না জানিয়ে ওই প্রতিষ্ঠানে সাত লাখ টাকা আমানত রেখেছিলেন। ওই টাকা ফেরত না পাওয়ায় স্বামীর সঙ্গে তাঁর ঝগড়া হয়। এরপর স্বামী তাঁকে বাড়ি থেকে বের করে দেন। এখন ওই নারী আশ্রয় নেন বাবার বাড়িতে। পিরোজপুর সদর উপজেলার টোনা গ্রামের আমিনুল ইসলামের মাধ্যমে এহসান গ্রুপে আমানত রেখেছিলেন কয়েকজন। তাঁদের একজন জামানতের ৯ লাখ টাকা ফেরত না পেয়ে আমিনুলের চার বিঘা জমি দখল করে নেন। আমিনুল চাষের জমি হারিয়ে এখন নিঃস্ব।
পিরোজপুর পৌরসভার খুমুরিয়া গ্রামের ইব্রাহিম খলিলুল্লাহ তাঁর অবসর ভাতার আট লাখ টাকা এহসান গ্রুপে জামানত রেখেছিলেন। তিনি বলেন, ‘লাভের আশায় টাকা রেখে এখন মানবেতর জীবন যাপন করছি।’ জেলা প্রশাসক আবু আলী মো. সাজ্জাদ হোসেন বলেন, ‘এহসান গ্রুপের গ্রাহকদের টাকা ফেরত দেওয়ার ব্যাপারে আমাদের কোনো উদ্যোগ নেওয়ার সুযোগ নেই। আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করব।’