খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বহির্বিভাগের তৃতীয় ও চতুর্থ তলায় করোনার টিকাদান কেন্দ্রে মর্ডানার প্রথম ও দ্বিতীয় ডোজ দেওয়া হচ্ছিল। আজ বৃহস্পতিবার দুপুর সাড়ে ১২টায় চতুর্থ তলায় লম্বা লাইন দেখা যায়। এ সময় পশ্চিম বানিয়াখামার এলাকার শেখ মাহমুদ হাসান নামের এক ব্যক্তি টিকা নিয়ে বের হচ্ছিলেন।
টিকা দেওয়ার অভিজ্ঞতা জানতে চাইলে মাহমুদ হাসান বলেন, ‘প্রায় আড়াই ঘণ্টা লাইনে দাঁড়ানোর পর টিকা পেলাম। ব্যবস্থাপনা মন্দের ভালো। তবে স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে না। প্রচণ্ড গরম। লাইনে দাঁড়ানোর জায়গায় ফ্যান নেই। আর সব জায়গার মতো কিছুটা স্বজনপ্রীতিও আছে। দুয়েকজন পরে এসে কীভাবে যেন আগে টিকা নিয়ে চলে যাচ্ছেন।’
দেশব্যাপী সম্প্রসারিত আকারে করোনার টিকাদান শুরুর প্রথম দিনের পর খুলনা নগরে ওই কর্মসূচির আওতায় আর কেউ টিকা পাননি। তবে সপ্তাহজুড়ে নগরের পাঁচটি হাসপাতালের নিয়মিত টিকাদান কেন্দ্রে টিকা পাচ্ছেন মানুষ। নগরে প্রতিদিন প্রায় পাঁচ হাজার মানুষ টিকা নিচ্ছেন। সকাল থেকেই টিকাকেন্দ্রে লম্বা লাইনে অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছে।
আমাদের উনি সিটি করপোরেশনের চাকরি করেন। যোগাযোগ আছে। আসার ১৫ মিনিটের মধ্যে টিকা নিতে পেরেছি।
আজ সকাল ১০টার দিকে খুলনা ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালের সামনে নারী ও পুরুষের আলাদা দুটি লাইনে টিকা নেওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলেন শতাধিক মানুষ। তখনো মানুষ আসছিলেন আর দাঁড়িয়ে যাচ্ছিলেন লাইনে। লোকজনের মুখে মাস্ক ছিল। তবে সামাজিক দূরত্ব বলতে কিছু ছিল না। ওই কেন্দ্রে টিকার প্রথম ও দ্বিতীয় উভয় ডোজই দেওয়া হচ্ছিল।
সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে নিয়মানুয়ায়ী টিকা দেওয়া হলেও দুয়েকটা স্বজনপ্রীতির ঘটনাও চোখে পড়ে। টিকা দিয়ে বেরিয়ে আসা ৩১ নম্বর ওয়ার্ডের টুটপাড়া হরিণটানা এলাকার একজন নারীর সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, ‘লম্বা লাইন থাকলেও লাইনে দাঁড়াতে হয়নি। আমাদের উনি সিটি করপোরেশনের চাকরি করেন। যোগাযোগ আছে। আসার ১৫ মিনিটের মধ্যে টিকা নিতে পেরেছি।’
টিকাকেন্দ্রের প্রধান ফটকের সামনে দাঁড়িয়ে পুলিশ এবং আনসার সদস্যরা হ্যান্ডমাইকে নির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছিলেন। এসএমএস পাওয়া ছাড়া যাঁরা টিকা নিতে এসেছেন, তাঁদের ফিরে যেতে বলা হচ্ছিল। গেটের বাইরের মতো ভেতরেও বড় লাইন। একসঙ্গে ১০ জনকে টিকাদানকক্ষে পাঠানো হচ্ছিল। ভেতরে বেশ সর্তকতার সঙ্গে কাজ চলছিল। টিকাগ্রহীতাদের কাছে নার্সরা শুনছিলেন, কেউ আগে ডোজ পেয়েছেন কি না, ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে কি না, এসব। সেখানকার একজন স্বাস্থ্যকর্মী বলেন, দুদিন আগে এক ব্যক্তিকে এক মিনিটের ব্যবধানে দুবার টিকা দেওয়ার ঘটনার পর থেকে সতর্কতা আরও বেড়েছে।
এদিকে অনেকে এসএমএস ছাড়াই টিকা নিতে এসে বিড়ম্বনায় পড়েছেন। এ রকম একজন নগরের শীতলবাড়ি এলাকার লাকি বেগম। তিনি বলেন, ‘নিবন্ধন করেছি, তবে এসএমএস আসেনি। তারপরও এলাকার একজনের কথামতো এসেছিলাম। সকাল সাতটা থেকে লাইনে দাঁড়ানো। যখন আমরা সিরিয়াল এল, তখন তো ঢুকতে পারলাম না।’
হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক কর্মকর্তা (আরএমও) এস এম মুরাদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, খুলনা নগরের কেন্দ্রগুলোর মধ্যে টিকা নেওয়ার জন্য সবচেয়ে বেশি চাপ জেনারেল হাসপাতালে। ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে এই কেন্দ্রে নগরের মধ্যে সর্বোচ্চসংখ্যক ৬৭ হাজার ডোজের বেশি টিকা দেওয়া হয়েছে। এখনো ৩২ হাজার লোক এখানে টিকার অপেক্ষায় রয়েছেন। জায়গার সংকট হওয়ায় সামাজিক দূরত্ব রক্ষা করাটা কঠিন হয়ে যায়।
দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মূল ভবনের দ্বিতীয় তলায় গিয়ে দেখা যায়, সেখানে অ্যাস্ট্রাজেনেকা ও সিনোফার্মের দ্বিতীয় ডোজ দেওয়া হচ্ছে। লোকজনের তেমন ভিড় নেই।
বেলা দেড়টায় শহীদ শেখ আবু নাসের বিশেষায়িত হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, তখন মাত্র ছয়-সাতজন টিকাগ্রহীতা রয়েছেন। বাইরে তখন প্রচণ্ড বৃষ্টি। ওই কেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত সিনিয়র স্টাফ নার্স মাহফুজা খাতুন বলেন, ভোর থেকেই লাইন শুরু হয়। কেন্দ্র খোলার আগেই লাইন দীর্ঘ হয়ে যায়। আজও কেন্দ্রে ১ হাজার ৪৫০ জন টিকা নিয়েছেন। আজ কোনো টিকার দ্বিতীয় ডোজ দেওয়া হয়নি।
খুলনা সিভিল সার্জনের কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, গণটিকার প্রথম দিনেই খুলনা নগরের ৩১টি কেন্দ্রে ৯৩টি বুথে ১৮ হাজার ৬০০ ডোজ মডার্নার টিকা দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ছিল। তবে সেদিন টিকা পেয়েছিলেন ১৯ হাজার ৯২৮ জন। এরপরে আর গণটিকা কার্যক্রম চলেনি।
খুলনা বিভাগীয় স্বাস্থ্য দপ্তরের তথ্য অনুয়ায়ী, গণটিকার আওতায় বিভাগে মোট ৩ লাখ ৯৭ হাজার ২০০ জনকে টিকা দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে বাগেরহাটে ৪৮ হাজার ৬০০ ডোজ, চুয়াডঙ্গায় ২৭ হাজার, যশোরে ৫৬ হাজার ৪০০, ঝিনাইদহে ৪৯ হাজার ২০০, খুলনা নগর ও জেলা মিলে ৫৯ হাজার ৪০০ ডোজ, কুষ্টিয়ায় ৪৫ হাজার ৬০০, মেহেরপুরে ১২ হাজার ৬০০, মাগুরায় ২৩ হাজার ৪০০, নড়াইলে ২৬ হাজার ৪০০ এবং সাতক্ষীরায় ৪৮ হাজার ৬০০ ডোজ টিকা দেওয়া হয়েছে।
খুলনা বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক (রোগনিয়ন্ত্রণ) ফেরদৌসী আক্তার বলেন, গণটিকা কর্মসূচির প্রথম দিনই বিভাগের ১০ জেলায় ৩ লাখ ৭৭ হাজার ৪৮০ ডোজ টিকা দেওয়া হয়। পরে ওই কার্যক্রমের আওতায় বিভিন্ন জেলায় আরও ১৯ হাজার ৭২০ ডোজ টিকা দেওয়া হয়েছে।