দৈনিক মজুরি ১২০ টাকা, পাঁচজনের সংসার চালাতে হিমশিম অবস্থা চা– শ্রমিকের

সিলেটের লাক্কাতুরা চা-বাগানে কাজ করছেন চা-শ্রমিকেরা
ছবি: আনিস মাহমুদ

জিতেন নায়েক। সিলেটের মালনীছড়া চা-বাগানের শ্রমিক। বাড়িতে তাঁর স্ত্রী কাজলি নায়েক, মা চাম্পা নায়েক, সঙ্গে সাত বছরের মেয়ে সুবর্ণা নায়েক এবং তিন বছরের ছেলে পবিত্র নায়েক। বাবা অনন্ত নায়েক মারা গেছেন প্রায় আট বছর আগে।

জিতেন নায়েক দৈনিক মজুরি পান ১২০ টাকা। পাঁচজনের পরিবারের খরচ নির্ভর করে জিতেন নায়েকের আয়ের ওপর। এ বেতনের পাশাপাশি রেশন হিসেবে সপ্তাহে আড়াই কেজি আটা পান তিনি।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো আজ রোববার দেশে মহান মে দিবস পালন করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস হিসেবে পরিচিত এই দিনে শ্রমিকদের অধিকার আদায় ও সুযোগ-সুবিধা বাস্তবায়নের কথা বলা হয়। কিন্তু বাস্তবে চা–শ্রমিক জিতেন নায়েকের মতো অনেক শ্রমিকের পরিবার সামান্য বেতনের চাকরি করে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে অনেক কষ্টে দিন কাটায়। এবারের মে দিবসের প্রতিপাদ্য করা হয়েছে, ‘শ্রমিক-মালিক একতা, উন্নয়নের নিশ্চয়তা’। প্রতিপাদ্যে একতার কথা বলা হলেও এমন অনেক মালিক আছেন, যাঁরা যথাসময়ে শ্রমিকদের বেতনও দেন না এবং খোঁজখবরও নেন না।

জিতেন নায়েক ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, মে দিবস এলে চা–শ্রমিকদের খোঁজ পড়ে। পরে আবার ভুলে যান শ্রমিকদের বঞ্চনার কথা। এক দিন শারীরিক অসুস্থতা কিংবা পারিবারিক প্রয়োজনে কাজে যেতে না পারলে মজুরি দেওয়া তো দূরের কথা, সাপ্তাহিক রেশন থেকেও কেটে নেওয়া হয়। এ সময় অর্ধাহারে দিন কাটাতে হয় পরিবারের সদস্যদের নিয়ে। এ ছাড়া চা–বাগানে রয়েছে চিকিৎসার অভাব।

শুধু জিতেন নায়েক নন, চা-বাগানে প্রতিটি শ্রমিক পরিবারের সদস্যদের কাটাতে হয় এমন কষ্টের জীবন। প্রায় দেড় বছর আগে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে নতুন চুক্তি অনুযায়ী ১৮ টাকা বৃদ্ধি করে দৈনিক ১২০ টাকা মজুরি নির্ধারণ করা হয়েছিল চা-শ্রমিকদের। এর আগে ১০২ টাকা দৈনিক মজুরি পেতেন তাঁরা।

শুধু জিতেন নায়েক নন, চা-বাগানে প্রতিটি শ্রমিক পরিবারের সদস্যদের কাটাতে হয় এমন কষ্টের জীবন। প্রায় দেড় বছর আগে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে নতুন চুক্তি অনুযায়ী ১৮ টাকা বৃদ্ধি করে দৈনিক ১২০ টাকা মজুরি নির্ধারণ করা হয়েছিল চা-শ্রমিকদের। এর আগে ১০২ টাকা দৈনিক মজুরি পেতেন তাঁরা।

বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে চা-জনগোষ্ঠীর সংখ্যা প্রায় সাড়ে ৭ লাখ।

সিলেটের দুটি চা-বাগানের শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সিলেট জেলায় রয়েছে ২২টি চা–বাগান। চা–বাগানগুলোতে শ্রমিকদের মধ্যে অধিকাংশ নারী। কিন্তু বাগানে নারী শ্রমিকদের অধিকার নেই। সরকারিভাবে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যকে গুরুত্ব দেওয়া হলেও চা–বাগানে এর প্রতিফলন দেখা যায় না। যেখানে বাইরে সাধারণ শ্রমিকের মজুরি দৈনিক ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা, সেখানে চা–শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি ১২০ টাকা, এটি হাস্যকর। অন্যদিকে চা–বাগানের শ্রমিকেরা বাগানের বাইরে ভাষাগত এবং বাগান কর্তৃপক্ষের কারণে শ্রম দিতে পারেন না।

সিলেটের মোমিনছড়া চা-বাগানের পঞ্চায়েত কমিটির সভাপতি লিটন মৃধা বলেন, ‘চা–শ্রমিকদের শ্রমমজুরির পাশাপাশি ভূমির সমস্যা রয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে বাগানে অবস্থান করলেও নিজেদের কোনো জমি নেই। বাগানের শ্রমিক না থাকলে বসবাসের জায়গা হারাতে হয়। আমরা সরকারের কাছে চা–শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি এবং জমি নিজ নামে বরাদ্দের দাবি জানিয়ে আসছি।’

শত বছর ধরে বাগানে চা–শ্রমিকেরা বসবাস করলেও তাঁদের কোনো নিজস্ব জমি নেই। এ ছাড়া বাগানে উন্নত মানের স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা নেই। শিক্ষার ব্যবস্থা নেই। কিছু বেসরকারি সংস্থার মাধ্যমে শিক্ষাব্যবস্থা করা হলেও বেশির ভাগ বাগানে শিক্ষার তেমন ব্যবস্থা নেই।
রাজু গোয়ালা, সভাপতি, সিলেট ভ্যালি (জেলার ২২টি বাগানের চা শ্রমিক ইউনিয়ন)

সিলেট ভ্যালির (জেলার ২২টি বাগানের চা শ্রমিক ইউনিয়ন) সভাপতি রাজু গোয়ালা বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে আমরা চা–শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির ব্যাপারে দাবি জানিয়ে আসছি। দীর্ঘ আন্দোলনের পর ১৮ টাকা বৃদ্ধি করে ১২০ টাকা করা হয়েছে। এখন আমরা নতুন চুক্তিতে ৩০০ টাকা মজুরি দাবি করছি। পাশাপাশি চা–শ্রমিকদের জমি নিজ নামে বরাদ্দের দাবি জানাচ্ছি।’ তিনি বলেন, শত বছর ধরে বাগানে চা–শ্রমিকেরা বসবাস করলেও তাঁদের কোনো নিজস্ব জমি নেই। এ ছাড়া বাগানে উন্নত মানের স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা নেই। শিক্ষার ব্যবস্থা নেই। কিছু বেসরকারি সংস্থার মাধ্যমে শিক্ষাব্যবস্থা করা হলেও বেশির ভাগ বাগানে শিক্ষার তেমন ব্যবস্থা নেই।

বাংলাদেশ চা শ্রমিক ফেডারেশনের উপদেষ্টা প্রণব জ্যোতি পাল বলেন, ‘২০ মে চা–শ্রমিকদের ১০১তম চা–শ্রমিক দিবস। এ দিবস সামনে রেখে আমরা ২০ মে-কে জাতীয়ভাবে চা-শ্রমিক দিবস হিসেবে ছুটি ঘোষণার দাবি করছি। চা–শ্রমিকদের ন্যূনতম দৈনিক মজুরি ৫০০ টাকা নির্ধারণের দাবি করছি। এ ছাড়া ৫ শতাংশ মুনাফা বণ্টনের বিধান বাস্তবায়নের দাবি করছি। এ ছাড়া চা–শ্রমিক জনগোষ্ঠীর প্রতিটি পরিবারকে সমাজসেবা অধিদপ্তরের অনুদানের তালিকায় যুক্ত করা, ভূমির অধিকার দেওয়া, চা–শ্রমিক সন্তানদের জন্য শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের বিশেষ কোটার ব্যবস্থা করার দাবি জানাচ্ছি।’

প্রণব জ্যোতি পাল বলেন, ‘দেশে ১৬৬টি চা-বাগানের মধ্যে হাতে গোনা মাত্রা ১০টি চা-বাগানে প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে। অধিকাংশ চা-বাগানে শিক্ষার ব্যবস্থা নেই। এ জন্য আমরা প্রতিটি বাগানে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপনের দাবি জানিয়ে আসছি।’

আরও পড়ুন

প্রণব জ্যোতি পাল আরও বলেন, দেশে চায়ের উৎপাদন বেড়েছে। দাম বেড়েছে। বিশ্বে চায়ের চাহিদা বেড়েছে। কিন্তু চা–শ্রমিকদের সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার ব্যাপারে কর্তৃপক্ষ বরাবরই কৃপণতা দেখিয়ে আসছে। ২০২১ সালে রেকর্ড পরিমাণ ৯ কোটি ৬৫ লাখ কেজি চা উৎপাদিত হয়েছে। এতে মালিকের মুনাফা বেড়েছে। এর বিপরীতে বেড়েছে শ্রমিকদের বঞ্চনা, শ্রম শোষণ, কমেছে মজুরি, কর্মসংস্থান। চা–শ্রমিকেরা ২০০ বছরের অধিক সময় ধরে বসবাস করে দেশের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েও চা–শ্রমিকদের নেই ভূমির অধিকার। নেই শ্রম আইন ও বিধিমালায় বর্ণিত ন্যূনতম সুবিধার বাস্তবায়ন।