ধারণা ও সচেতনতা কম

* জরিপের উত্তরদাতাদের বেশির ভাগই ধাক্কাধাক্কি, থাপ্পড়, পাথর ছুড়ে মারা ও উত্ত্যক্ত করা সহিংসতা হিসেবে বিবেচনা করেন না।

* সরকারি-বেসরকারি প্রচার-প্রচারণা থাকলেও তা অপ্রতুল। সচেতনতা বাড়াতে কার্যক্রম জোরদার করতে হবে।

* দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের দিকে নজর দিতে হবে।

নারী নির্যাতন
প্রতীকী ছবি

নারীর প্রতি যেকোনো ধরনের সহিংসতা বা হয়রানি সম্পর্কে বরিশালসহ দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের ধারণা এখনো অস্পষ্ট। তাঁদের বেশির ভাগই নারীর প্রতি কোনটি হয়রানিমূলক আচরণ ও কোনটি তা নয়, এ বিষয়ে পার্থক্য করার ক্ষেত্রে সচেতন নন। ফলে পরিবার, সামাজিক অঙ্গন, হাটবাজার, কর্মক্ষেত্র ও শিক্ষাক্ষেত্রে শিশু-কিশোরী-তরুণীসহ নারীদের নিগৃহীত হওয়াকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করার প্রবণতা কম।

এ ক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারি প্রচার-প্রচারণা থাকলেও তা অপ্রতুল। সচেতনতা বাড়াতে নেওয়া কার্যক্রম জোরদারের পাশাপাশি দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের দিকে নজর দেওয়ার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন নারী অধিকারকর্মীরা।

বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাক পরিচালিত জরিপেও হতাশাজনক তথ্য উঠে এসেছে। দেশের ৪০ জেলায় ২০২০-২০২১ সালে চালানো এ জরিপে বরিশাল বিভাগের বরিশাল, বরগুনা ও পটুয়াখালী জেলা অন্তর্ভুক্ত ছিল।

জরিপের ফলাফলে দেখা যায়, উত্তরদাতাদের মধ্যে বেশির ভাগই ধাক্কাধাক্কি, থাপ্পড়, পাথর ছুড়ে মারা ও উত্ত্যক্ত করা সহিংসতা হিসেবে বিবেচনা করেন না। মাত্র ৩৫ শতাংশ উত্তরদাতা নারীর প্রতি যেকোনো অশোভন আচরণকেই সহিংসতা বিবেচনা করেন। ৫৬ শতাংশ উত্তরদাতা কেবল জোরপূর্বক যৌন হয়রানিকে সহিংসতা বিবেচনা করেন।

২৩ শতাংশ মনে করে, পরিবার একত্রে রাখার জন্য নারীদের সহিংসতা সহ্য করা উচিত। ৫৭ শতাংশ মনে করে, সহিংসতা সম্পর্কিত আচরণ নারীদের উপেক্ষা করা উচিত। আর ৩৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ উত্তরদাতা এগুলোকে সহিংসতা হিসেবে মত দিয়েছেন।

১৯৯৩ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে গৃহীত হয় ‘নারীর প্রতি সহিংসতা নির্মূলে জাতিসংঘ ঘোষণা’। এতে নারীর প্রতি সহিংসতার সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, ‘ব্যক্তিগত বা সামাজিক জীবনে জেন্ডার–ভিত্তিক যেকোনো সহিংসতা, যার ফলে নারীর শারীরিক, যৌন অথবা মানসিক অসুস্থতা দেখা দেয় বা দিতে পারে। সেই সঙ্গে এসব বিষয়ে হুমকি, বলপ্রয়োগ বা বঞ্চনা।’

এ বিষয়ে বরিশাল নগরের অন্তত ১১ জন নারীর সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়। তাঁদের বয়স ১৭ থেকে ৩৫ বছর। পেশায় শিক্ষার্থী, চাকরিজীবী ও গৃহিণী। তাঁরা বলেন, কর্মক্ষেত্র, শিক্ষাঙ্গন ও বাজারে যাওয়া-আসার সময় প্রায় প্রতিদিন তাঁদের কোনো না কোনোভাবে যৌন হয়রানির শিকার হতে হয়। কখনো গণপরিবহনে, কখনো কর্মক্ষেত্রে আবার কখনো লোকালয়ে।

এদের মধ্যে একজন বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রশাসনিক কর্মকর্তা। তিনি ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা বা মাহেন্দ্রতে করে অফিসে যাতায়াত করেন। এসব গণপরিবহনে তাঁকে পুরুষ যাত্রীদের সঙ্গে গাদাগাদি করে বসতে হয়। এ ক্ষেত্রে পুরুষ যাত্রীদের অপলক তাকিয়ে থাকা ও ইচ্ছাকৃতভাবে ঘেঁষাঘেঁষি করে বসার মতো অস্বস্তিকর অবস্থায় পড়তে হয়। আবার স্ট্যান্ডে শিস দিয়ে বা অন্যের উদ্দেশে অশ্লীল কথাবার্তা বলে হয়রানি করা হয়। তিনি বলেন, প্রতিনিয়ত এমন ঘটনার শিকার হলেও একা থাকায় প্রতিবাদ করা যায় না। আবার পুরুষদের মধ্যে কেউ এ নিয়ে প্রতিবাদ করেন না।

বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের চারজন শিক্ষার্থী জানিয়েছেন, প্রতিদিনই তাঁরা স্থানীয় বখাটে তরুণ, এমনকি বয়স্ক লোকদের অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি, শিস কাটার মতো ঘটনার শিকার হচ্ছেন। আবার ভাই-বন্ধু, সহপাঠী বা আত্মীয়ের সঙ্গে বাইরে গেলে নানা প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। সম্প্রতি বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক আবাসিক শিক্ষার্থী তাঁর স্বামীর সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশের এলাকায় ঘুরতে গেলে স্থানীয় বখাটেরা তাঁর স্বামীকে মারধর এবং ওই ছাত্রীকে গালাগালসহ লাঞ্ছিত করেন।

এসব বিষয়ে বরিশাল মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক পুষ্প রানী চক্রবর্তী বলেন, ‘আমাদের শিক্ষা তেমন কোনো সচেতনতাবোধ তৈরি করতে ব্যর্থ হচ্ছে। কেবল ভয় দিয়ে, আইন করে নারীর প্রতি সহিংসতা বা যৌন হয়রানি রোধ করা অসম্ভব, যতক্ষণ বোধ জাগ্রত না হবে।’

পুষ্প রানী চক্রবর্তী মনে করেন, নারী ও পুরুষ সম্পর্কে প্রচলিত সামাজিক কিছু ধারণা যৌন সহিংসতার অন্যতম কারণ। বেশির ভাগ মানুষ মনে করেন, পুরুষেরা তুলনামূলক বেশি ক্ষমতাশালী, তাই যৌন সম্পর্ক তাঁরাই নিয়ন্ত্রণ করবেন। ক্ষমতার অসমতা নারীকে পুরুষের অধস্তন করে রেখেছে। এ ক্ষেত্রে বিচারহীনতার সংস্কৃতিও কম দায়ী নয়।