চট্টগ্রামে হেলে পড়েছে ৩ ভবন
নকশা ছাড়া গড়ে উঠেছে ভবনগুলো
হেলে পড়া ভবনের অংশবিশেষ অপসারণ, ক্ষতিপূরণের দাবিতে সড়ক অবরোধ বাসিন্দাদের।
চট্টগ্রাম নগরের মাঝিরঘাটে হেলে পড়া তিনটি ভবন নিয়ম না মেনে নকশা ছাড়াই গড়ে উঠেছে। তবে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) ভবনগুলো এখন অবৈধ বললেও এত দিন কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। হেলে পড়ার পর ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করেছে। সরিয়ে নিয়েছে বাসিন্দাদের।
গত সোমবার বিকেলে মাঝিরঘাট এলাকার গুলজার খালের পাশে পার্বতী ফকিরপাড়া এলাকায় খালে প্রতিরোধ দেয়াল নির্মাণের জন্য খননকাজের কারণে ভবন তিনটি হেলে পড়ে। সিডিএর জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের আওতায় ওই খালে খননকাজ চলছে। প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সেনাবাহিনীর ৩৪ ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্রিগেড।
হেলে পড়া ভবনগুলোর মধ্যে রয়েছে একটি তিন তলা, একটি দোতলা ও এক তলার একটি মন্দির। এ ছাড়া দেবে গেছে একটি টিনের ঘরও। সোমবার রাতেই ভবন থেকে বাসিন্দাদের সরিয়ে নেওয়া হয়। ভবন ২টি ও টিনের ঘরে অন্তত ১০টি পরিবার থাকত। ভার কমাতে গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে ভবনের অংশবিশেষ অপসারণ করে সিডিএ।
সিডিএর প্রধান নগর–পরিকল্পনাবিদ শাহীনুল ইসলাম খান প্রথম আলোকে বলেন, হেলে পড়া ভবনগুলো অবৈধ। এগুলোর কোনো নকশা অনুমোদন নেই। আর সিডিএ নকশা অনুমোদনের সময় খালপাড় থেকে ১২ ফুট দূরে ভবন নির্মাণের শর্ত দিয়ে থাকে। কিন্তু ওই ভবনগুলো নির্মাণ করা হয়েছে একেবারে খালের পাড় ঘেঁষে।
চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের প্রধান মুহাম্মদ রাশিদুল হাসান বলেন, যদি ভবনগুলো অবৈধ হয়ে থাকে, তাহলে সিডিএ এত দিন কোথায় ছিল? কেন এগুলো অপসারণের জন্য নোটিশ কিংবা ব্যবস্থা নেয়নি।
গতকাল বেলা সাড়ে ১১টায় সরেজমিনে দেখা যায়, মূল রাস্তার পাশেই পার্বতী ফকিরপাড়া। পাড়ায় প্রবেশে প্রশস্ত কোনো রাস্তা নেই। সরু গলি দিয়ে ভেতরে যেতে হয়। খালের একেবারে পাড় ঘেঁষে গড়ে উঠেছে ভবনগুলো। কোনোটি একতলা, কোনোটি দোতলা ও তিনতলা। মাঝখানে এক ফুট ফাঁকা জায়গাও নেই। সেখানে বসবাস করা লোকজন স্বল্প আয়ের।
ভবনগুলো বৈধ না অবৈধ, তা পরের বিষয়। যদি ভবনগুলো অবৈধ হয়ে থাকে, তাহলে সিডিএ এত দিন কোথায় ছিল?
ঘটনাস্থলে দেখা যায়, হেলে পড়া ভবনের বাসিন্দারা নিজেদের জিনিসপত্র সরিয়ে নিচ্ছেন। সেসব নিয়ে রাখছেন প্রতিবেশী ও আত্মীয়স্বজনের বাসায়। হেলে পড়া তিন তলা ভবনের বিভিন্ন অংশে ফাটল দেখা গেছে। পাশের টিনের ঘরের মেঝে দেবে গেছে। সেখানেও ফাটল সৃষ্টি হয়েছে। এ কারণে পুরো পাড়ায় আতঙ্ক দেখা দেয়।
হেলে পড়া তিনতলা ভবনের অন্যতম মালিক স্বপন দাস জানান, এটি তাঁদের পূর্বপুরুষের ভিটা। সিডিএর অনুমোদন নিয়ে চার বছর আগে তিন ভাই মিলে ভবনটি নির্মাণ করেছিলেন। এ জন্য ধারকর্জ করতে হয়েছে। খালের খননকাজ শুরুর আগেই ভবনের বর্ধিত অংশ ভেঙে দিয়েছিল সিডিএ। এরপর যখন লোহার পাতগুলো পোঁতা হচ্ছিল, তখন কম্পনের কারণে ভবনগুলোতে ফাটল দেখা দেয়। বিষয়টি প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থাকে জানানো হয়েছিল। কিন্তু কেউ তাদের কথা শোনেনি। তখন প্রয়োজনীয় নিরাপত্তাব্যবস্থা নেওয়া হলে আজ এই পরিণতি হতো না।
সরেজমিনে দেখা যায়, প্রতিরোধ দেয়াল নির্মাণকাজে খালের পাড়ে যাতে ধস না হয়, সে জন্য লোহার পাত পুঁতে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু খননকাজ চলাকালে ওই পাতগুলোও বেঁকে গেছে। মাটি ধসে পড়ায় ভবনগুলোও খালের দিকে কাত হয়ে পড়ে। এর মধ্যেই চলছিল খননকাজ।
ঘটনাস্থলে কথা হয় জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. শাহ আলীর সঙ্গে। তিনি দাবি করেন, নির্মাণকাজের জন্য তাঁরা পর্যাপ্ত নিরাপত্তাব্যবস্থা নিশ্চিত করেছেন। প্রায় ৪০ ফুট গভীর পর্যন্ত লোহার পাত পোঁতা হয়েছে; কিন্তু ভবনগুলোর ভিত নড়বড়ে। নকশা অনুযায়ী নির্মাণ করা হলে এমন অবস্থা হতো না।
এদিকে গতকাল বেলা পৌনে একটায় ভবনগুলোর অপসারণ কাজ শুরু করে সিডিএ। এ সময় ক্ষতিগ্রস্ত ভবনের মালিক ও স্থানীয় বাসিন্দারা সিডিএর কর্মকর্তাদের কাছে ছুটে যান। তাঁরা ভবনের ক্ষতিপূরণ দাবি করেন। কিন্তু ভবনগুলো অবৈধ হওয়ায় ক্ষতিপূরণের সুযোগ নেই বলে জানান কর্মকর্তারা।
এরপর ক্ষিপ্ত লোকজন বেলা সোয়া একটায় মাঝিরঘাটের স্ট্র্যান্ড রোড অবরোধ শুরু করেন। এতে ব্যস্ততম সড়কের দুই পাশে পণ্যবাহী ট্রাক, কাভার্ড ভ্যানসহ বিভিন্ন যানবাহন আটকা পড়ে জট সৃষ্টি হয়। পরে তাঁরা সিডিএ চেয়ারম্যানের সঙ্গে বৈঠকের আশ্বাসে অবরোধ তুলে নেন।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের প্রধান মুহাম্মদ রাশিদুল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, উন্নয়ন কর্মকাণ্ড চলার সময় সংশ্লিষ্ট এলাকায় জননিরাপত্তা নিশ্চিত করা সংশ্লিষ্ট সংস্থা ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব। ভবনগুলো বৈধ না অবৈধ তা পরের বিষয়। যদি ভবনগুলো অবৈধ হয়ে থাকে, তাহলে সিডিএ এত দিন কোথায় ছিল? কেন এগুলো অপসারণের জন্য নোটিশ কিংবা ব্যবস্থা নেয়নি।