বেষ্টনীর একটি কক্ষে নদীর সঙ্গে থাকত সম্রাট। সম্পর্কে মা-ছেলে হলেও ঝগড়া-বিবাদেই কাটত দুটির সময়। সর্বশেষ গত ২৮ ফেব্রুয়ারি মায়ের (নদীর) গলা ও পেটে কামড় বসিয়ে দেয় সম্রাট। সেই থেকে আলাদা কক্ষে একাকী কাটছে নদীর জীবন। তার জীবন এখন সংকটাপন্ন। ২০ দিন ধরে পানি ছাড়া কিছুই মুখে তুলছে না। চিকিৎসকেরা বলছেন, সম্ভবত নদীকে আর প্রাণে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হবে না।
নদী একটি সিংহীর নাম। কক্সবাজার শহর থেকে ৬৭ কিলোমিটার দূরে চকরিয়ার ডুলাহাজারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কের সিংহ-বেষ্টনীতে নদীর জন্ম, বয়স এখন ১৫ বছর। একই বেষ্টনীতে ২২ বছর বয়সী আরেক সিংহ সোহেলের সঙ্গে ১১ বছরের সংসার ছিল নদীর। তাদের সংসারে জন্ম নেয় টুম্পা (১০) ও সম্রাট (৯) নামের দুই সন্তান।
সোহেলের প্রথম সংসার ছিল হীরা নামের আরেকটি সিংহীর সঙ্গে। হীরার পেটে জন্ম সিংহ রাসেলের (১৫)। রাসেলকে রেখে বেষ্টনীতে মারা যায় হীরা। গত ২৩ ফেব্রুয়ারি বিকেল সাড়ে চারটার দিকে নদী, টুম্পা, সম্রাট ও রাসেলকে রেখে পৃথিবী থেকে বিদায় নেয় সোহেল। এখন ৭৫ একরের সিংহ-বেষ্টনীতে সিংহ আছে চারটি—নদী, টুম্পা, রাসেল ও সম্রাট। এর মধ্যে নদীর জীবন বিপন্ন।
বৃহস্পতিবার দুপুরে বেষ্টনীতে গিয়ে দেখা গেছে, একটি কক্ষের কোনায় শুয়ে আছে নদী। শরীর দুর্বল, ওজনও কমছে। ছবি তোলার সময় মাথা তুলে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে সে। তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকানো নদীর মুখ হাঁ করলেও হুংকার কিংবা গর্জন করার শক্তি-সামর্থ্য নেই, সেটা বোঝা গেল। মুখের নিচে গলায় সম্রাটের কামড়ের লাল দাগ দূর থেকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। মঙ্গলবার ছাড়া সপ্তাহের প্রতিদিন বিকেলে প্রতিটি সিংহকে খাওয়ানো হয় সাত কেজি মাংস। কিন্তু তিন সপ্তাহ ধরে নদী পানি ছাড়া কিছুই খাচ্ছে না। সম্ভবত গলায় ব্যথা।
সাফারি পার্কের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (তত্ত্বাবধায়ক) মো. মাজহারুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, নদীর অবস্থা সংকটাপন্ন, দিন দিন অবনতির পথে, সম্ভবত তাকে আর বাঁচানো সম্ভব হবে না। ২০০৪ সালে চার বছর বয়সে এই পার্কে আনা হয়েছিল সোহেলকে। সোহেলের সঙ্গে এই বেষ্টনীতে নদীর কেটেছে টানা ১১ বছর। নদী (মা) চলে গেলে সম্রাট, রাসেল আর টুম্পার আচরণ কেমন হয় দেখার বিষয়। যেমনটা তাদের বাবা সোহেলের মৃত্যুর পর ঘটেছিল। তখন পশুগুলোর মধ্যে আগ্রাসী মনোভাব লক্ষ করা গিয়েছিল। প্রায় সময় একে অন্যের ওপর আক্রমণ করত, ঝগড়া করত। যদিও বার্ধক্যজনিত কারণেই সোহেলের মৃত্যু হয়েছিল।
পার্ক কর্তৃপক্ষ জানায়, সোহেলের মৃত্যুর পর সঙ্গিনী নদী একা হয়ে পড়েছিল। তখন নদীর সঙ্গী হিসেবে কক্ষে রাখা হতো সন্তান সম্রাটকে। মায়ের সঙ্গে ছেলের বয়সের ব্যবধান ছিল সাত বছর। কিন্তু সময়টা দুজনের ভালো যাচ্ছিল না। প্রায় সময় মায়ের ওপর বর্বর অত্যাচার চালাত সম্রাট। গত ২৮ ফেব্রুয়ারি মায়ের (নদীর) পেট ও গলায় কামড় বসিয়ে দেয় সম্রাট। তাতে অসুস্থ হয়ে পড়ে নদী। এর পর থেকে নদীকে পৃথক আরেকটি কক্ষে রেখে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কের ভেটেরিনারি সার্জন হাতেম সাজ্জাত মো. জুলকার নাইন প্রথম আলোকে বলেন, অসুস্থ সিংহীর (নদীর) উন্নত চিকিৎসার জন্য একাধিকবার মেডিকেল বোর্ড বসানো হয়। সিরাম ও রক্তের নমুনা পরীক্ষা করে সিংহীর শরীরে ‘ভাইরাল ইনফেকশন’ পাওয়া গেছে, যার লক্ষণ ভালো নয়। চিকিৎসার জন্য গত ১ এপ্রিল মেডিকেল বোর্ড সিংহীকে অবশ করেছিল। ফলে তার চেতনা ফিরে আসতে সময় লেগেছিল প্রায় পাঁচ ঘণ্টা। এরপর নমুনা সংগ্রহ করার জন্য পুনরায় অবশ করা যাচ্ছে না। কারণ, তার শরীর দুর্বল। বিষয়টি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। চেতনা ফিরে না এসে মৃত্যুর শঙ্কা আছে।
বর্তমানে সিংহীটির অবস্থা সংকটাপন্ন। দিন দিন অবনতি ঘটছে। গত ২৭ মার্চ থেকে সিংহী পানি ছাড়া অন্য খাবার মুখে তুলছে না। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছে পার্ক কর্তৃপক্ষ।
প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা সুপন নন্দী বলেন, স্বাভাবিক অবস্থায় সিংহ বাঁচে ১৫ থেকে ১৮ বছর। সাফারি পার্কে মরে যাওয়া সোহেলের বয়স ছিল ২২ বছর। নদীর বয়সও ১৫ বছরের বেশি।
দুই বছর ধরে সিংহগুলোকে লালন-পালন করছেন পার্কের প্রাণী সংরক্ষক আকতার হোসেন। তিনি বলেন, আগে দর্শনার্থীরা বেষ্টনীতে গেলে হুংকার ছাড়ত নদী। এখন দূর থেকে চেয়ে থাকে, চুপচাপ পড়ে থাকে। জীবনীশক্তি যেন ফুরিয়ে আসছে।
পার্ক সূত্র জানায়, ২০০১ সালের ১৯ জানুয়ারি ২ হাজার ২৫০ একর আয়তনের ডুলাহাজারার বনে গড়ে তোলা হয় দেশের প্রথম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্ক। এর আগে ১৯৮০ সালে এটি ছিল হরিণ প্রজননকেন্দ্র। বর্তমানে পার্কে জেব্রা, ওয়াইল্ড বিস্ট, জলহস্তী, ময়ূর, অজগর, কুমির, হাতি, বাঘ, ভালুক, সিংহ, হরিণ, লামচিতা, শকুন, কচ্ছপ, রাজধনেশ, কাকধনেশ, ইগল, সাদা বক, রঙিলা বক, সারস, কাস্তেচরা, মথুরা, নিশিবক, কানিবক, বনগরুসহ ৫২ প্রজাতির ৩৪১টি প্রাণী আছে। এগুলো আবদ্ধ অবস্থায় আছে। উন্মুক্তভাবে আছে ১২৩ প্রজাতির ১ হাজার ৬৫টি প্রাণী। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো গুইসাপ, শজারু, বাগডাশ, মার্বেল ক্যাট, গোল্ডেন ক্যাট, ফিশিং ক্যাট, খ্যাঁকশিয়াল ও বনরুই।