নদ-নদীর পানি বিপৎসীমার ওপরে, পানিবন্দী মানুষের চরম দুর্ভোগ
কুড়িগ্রামের সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। বেড়েছে ধরলা ও ব্রহ্মপুত্রের পানি। আজ শুক্রবার বেলা তিনটায় ব্রহ্মপুত্রের পানি বিপৎসীমার ৫০ সেন্টিমিটার ও ধরলার পানি বিপৎসীমার ৪১ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে বলে জানিয়েছেন পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)।
নদ-নদীর পানি বৃদ্ধির ফলে জেলার তিন শতাধিক চরের লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। নদীতীরবর্তী এলাকা চরের শতভাগ আমন ফসল এখন পানির নিচে। কৃষি বিভাগের দেওয়া তথ্যমতে, এ পর্যন্ত জেলার ২৫ হাজার হেক্টর জমির ফসল পানিতে নিমজ্জিত রয়েছে।
আজ শুক্রবার ব্রহ্মপুত্র নদের কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার যাত্রাপুর ইউনিয়নের মাঝামাঝি পোড়ার চর, কালীর আলগার চর, পার্বতীপুর, খাসের চর ও আলোর চর ঘুরে দেখা গেছে, বেশির ভাগ ঘরবাড়িতে পানি উঠেছে। ঘরের ভেতর মাচায়, নৌকা ও কলাগাছের ভেলা দিয়ে চলাচল করছে মানুষ। পোড়ার চরে গিয়ে দেখা যায়, ব্রহ্মপুত্রের পানি তীব্র বেগে পূর্ব দিক থেকে এসে চরে আঘাত হানছে। বাড়ি, ভিটা, গাছপালা ভেঙে পড়ছে। লোকজন ঘরবাড়ি সরাতে ব্যস্ত। রেজাউল করিম নামের স্থানীয় এক বাসিন্দা জানান, চরের অধিকাংশ বাড়িতে পানি উঠেছে। সঙ্গে ভাঙন দেখা দিয়েছে।
খাসের চরের পূর্ব দিকে গিয়ে দেখা যায়, শতাধিক বাড়িতে পানি উঠেছে। পরিবারের সদস্যরা মাচা তৈরি করে বসবাস করছে।
কালীর আলগার চরে আবাসন প্রকল্পের দুটি ইউনিটে ১৪৬টি পরিবার বসবাস করত। চার বছর আগে দেখা দেওয়া ভাঙনে প্রকল্পের এখন বিধ্বস্ত অবস্থা। বর্তমানে এই দুই ইউনিটে চারটি পরিবার টিকে আছে। আধা পাকা ঘরের ইট খুলে নৌকায় তুলে নিয়ে যাচ্ছে অনেকে। একটি ঘরের মালিক সোনাভান বিবি বলেন, ‘খুব দুরবস্থার মধ্যে পড়ছি। আবাসান ভাঙ্গি শ্যাষ। হামরা অন্য চরে জাবার নাগছি।’
ময়েজ উদ্দিন বলেন, ‘বন্যার শুরু থাকি বসে আছি। কাজকাম নাই। এখন পর্যন্ত কোনো সাহায্য পাই নাই। চরের সব মানুষের একই অবস্থা।’
খাসের চরের পূর্ব দিকে গিয়ে দেখা যায়, শতাধিক বাড়িতে পানি উঠেছে। পরিবারের সদস্যরা মাচা তৈরি করে বসবাস করছে। সফিকুল ইসলাম বলেন, বন্যার পানির স্রোতে পাঁচটি গরু ভেসে গেছে। গরু ও মানুষের খাবারের সমস্যা দেখা দিয়েছে।
নৌকা থামাতেই কলার ভেলা নিয়ে এসে নুরজাহান বেগম বলেন, ‘আছিলাম পশ্চিম পাশে, এক মাস আগে এইখানে আসছি। বাড়িতে পানি। স্বামী মজিবর রহমান টাঙ্গাইলে কৃষিকাজ করে, করোনার সময় থাইকা বাড়িত বসি। খুব সমস্যায় পড়ছি। আর চলবার পারি না।’ সোহরাব আলীর বাড়িতে পানি ওঠায় মসজিদের পাশে একটি পরিত্যক্ত ঘরে আশ্রয় নিয়েছেন। সেখানেও পানি। এর মধ্যে তাঁর স্ত্রী মল্লিকা বেগম সন্তান প্রসব করেছেন। মল্লিকা বলেন, ‘ছাওয়া নিয়া পানির মধ্যে খুব অসুবিধায় আছি।’
মাঝের চরের একেই অবস্থা। পশ্চিম পাশে অনেক বাড়িতে পানি উঠেছে। এখানকার বাসিন্দা মেহের জামাল বলেন, ‘আমরা দক্ষিণ পাশে ছিলাম। নদীভাঙনে এখানে এসে বাড়ি করেছি। পানির মধ্যে পইড়া আছি। কামাই কাজ নাই। খাওয়ার পানির সমস্যা। টিউবল অর্ধেক পানিতে।’
কালীর আলগার চরের সাবেক ইউপি সদস্য আসাদ আলী জানান, চরগুলোর পূর্বে ভারতের আসাম রাজ্যের ধুপড়ি জেলা। ব্রহ্মপুত্র নদ ধুপড়ি থেকে প্রবাহিত হয়ে কুড়িগ্রাম জেলার যাত্রাপুর ইউনিয়নের রলাকাটার চরের পাশ দিয়ে প্রবেশ করেছে। পাশাপাশি উত্তর দিক থেকে গঙ্গাধর ও দুধকুমার এসে যাত্রাপুরের এসব চরের কাছে মিলিত হয়েছে। যে কারণে এখানে বন্যা ও নদীভাঙনের প্রবণতা বেশি।
যাত্রাপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আইয়ুব আলী সরকার বলেন, তাঁর ইউনিয়নে ২ হাজার ৫০০ পরিবার পানিবন্দী। এর মধ্যে ৪০০ পরিবার বরাদ্দ পেয়েছে। চরের নিচু এলাকার সব ঘরে পানি উঠেছে। পানিবন্দী মানুষ খুব কষ্টে আছে।
জেলার ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা আবদুল হাই সরকার বলেন, জেলায় এ পর্যন্ত ২৮০ মেট্রিক চাল, নগদ ১২ লাখ টাকা ও ১ হাজার ৫০০ প্যাকেট শুকনা খাবার এসেছে। বন্যাকবলিত এলাকায় এগুলো বিতরণ করা হচ্ছে।