পারাপারের অপেক্ষায় ছয় শতাধিক পণ্যবাহী ট্রাক
মাদারীপুরের বাংলাবাজার ও মুন্সিগঞ্জের শিমুলিয়া নৌপথে ফেরি পারাপারে দুর্ভোগ বেড়েই চলেছে। পদ্মা সেতুর নিরাপত্তা ও নৌপথে যেকোনো ধরনের দুর্ঘটনা এড়াতে বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টার পর থেকে যাত্রীবাহী বাস, পণ্যবাহী ট্রাকসহ কোনো ভারী যানবাহন ফেরিতে নেওয়া হচ্ছে না। পাশাপাশি সীমিত করা হয়েছে ফেরি চলাচল। শুধু বাংলাবাজার ঘাটের টার্মিনালেই আটকা পড়েছে ছয় শতাধিক পণ্যবাহী ট্রাক। ট্রাকগুলোর বেশির ভাগই পাঁচ-সাত দিন ধরে পারাপারের অপেক্ষায় সেখানে আছে।
এর আগে বিআইডব্লিউটিসির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বুধবার থেকে ১০টি ফেরিতে ধারণক্ষমতার অর্ধেক যানবাহন তোলা হচ্ছিল। এক দিনের মাথায় আবারও সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের ফলে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ঘাটে আটকে থাকা পণ্যবাহী ট্রাকের চালকেরা।
বিআইডব্লিউটিসি ঘাট সূত্র জানায়, পদ্মায় তীব্র স্রোত থাকায় মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে ফেরি চলাচল। পারাপারে প্রতিটি ফেরির লাগছে দ্বিগুণের বেশি সময়। ফেরিগুলো নৌপথের চ্যানেল অতিক্রম করতে গিয়ে তীব্র স্রোতের মুখে পড়ে প্রায় দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে। সম্প্রতি স্রোতের কারণে তিনটি রো রো ফেরি পদ্মা সেতুর তিনটি পিলারের সঙ্গে ধাক্কা খায়। আহত হয় বেশ কয়েকজন যাত্রী। নৌপথের সব ধরনের দুর্ঘটনা ও পদ্মা সেতুর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বুধবার থেকে সীমিত করা হয় ফেরি চলাচল। একই সঙ্গে ফেরিতে সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ ভারী যানবাহন তোলার নির্দেশনা দেওয়া হয়। এক দিন যেতেই আবারও সিদ্ধান্ত বাদলায় বিআইডব্লিউটিসি। বৃহস্পতিবার সকাল থেকে এই নৌপথে চলাচলকারী সব কটি রো রো ফেরি বন্ধ করে দেওয়া হয়। নৌপথে ১৮টি ফেরি সচল থাকলেও বর্তমানে থেমে থেমে চলছে কুঞ্জলতা, কদম, কাকলি, ক্যামেলিয়া ও কুমিল্লা নামের ৫টি ছোট ফেরি।
জানতে চাইলে বিআইডব্লিউটিসি বাংলাবাজার ফেরিঘাটের ব্যবস্থাপক (বাণিজ্য) সালাউদ্দিন আহমেদ বিকেল ৫টায় প্রথম আলোকে বলেন, ‘পদ্মা সেতুর নিরাপত্তা ও তীব্র স্রোত থাকায় সকালে নতুন সিদ্ধান্ত এসেছে। সেই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কোনো যাত্রীবাহী বাস, ট্রাকসহ ভারী যানবাহন ফেরিতে লোড দেওয়া যাবে না। বড় ফেরিগুলোও বন্ধ করে দিতে হবে। আমরা কর্তৃপক্ষের নির্দেশনামতো রো রো ফেরি বন্ধ করে দিয়েছি। কোনো ট্রাক, বাস লোড নিচ্ছি না।’
সালাউদ্দিন আহমেদ আরও বলেন, ‘ঘাটে ফেরি কম চলায় করুণ পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছি আমরা। কোনোভাবেই পরিস্থিতি সামাল দিতে পারছি না। যানবাহনের প্রচুর চাপ। শত শত গাড়ি পারাপারের অপেক্ষায়। ঘাটে যে কয়টা ফেরি চলে, তা অ্যাম্বুলেন্স দিয়েই ভরে যাচ্ছে। নতুন করে কোনো ছোট গাড়ি তুলতে পারছি না।’
বাংলাবাজার ফেরিঘাটে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দুপুর ১২টা থেকে এই নৌপথে একদমই সীমিত করা হয় ফেরি চলাচল। একই সঙ্গে পণ্যবাহী ট্রাকসহ ভারী যানবাহন ফেরিতে তোলা হচ্ছে না। এরপরও ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে যানবাহনের চাপ। বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত বাংলাবাজার ফেরিঘাটের সংযোগ সড়কেই আটকা পড়ে তিন শতাধিক ছোট গাড়ি। এর মধ্যে অর্ধশত ছিল অ্যাম্বুলেন্স। অ্যাম্বুলেন্সগুলো অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ফেরিতে তোলা হলেও এর জন্য একেকটি অ্যাম্বুলেন্সকে দুই থেকে তিন ঘণ্টা ফেরির জন্য অপেক্ষা করতে হচ্ছে ঘাটে। অনেকে গুরুতর রোগী নিয়ে এসেও ফেরি না পেয়ে ফিরে যাচ্ছেন বিকল্প নৌপথে। অন্যদিকে বাংলাবাজার ঘাটের টার্মিনালে আটকা পড়েছে ছয় শতাধিক পণ্যবাহী ট্রাক। ট্রাকগুলোর বেশির ভাগই পাঁচ–সাত দিন ধরে পদ্মা পারাপারের জন্য অপেক্ষা করছে।
এক সপ্তাহ ধরে টার্মিনালে আটকা পণ্যবাহী ট্রাকের চালক আসাদ শিকদার বলেন, ‘বুধবার রাতে ও বৃহস্পতিবার সকালে আটকে পড়া কিছু ট্রাক লোড নিল। আবার দুপুরে শুনি, নিবে না। এমন নাটক ঘাট কর্তৃপক্ষ কেন করতাছে? আমাগো কি তাগের কাছে খেলনা মনে হয়। ঘাটে দিনের পর দিন পইরা থাকলে তারা আমাগো কষ্টটা বুঝতো।’
ঢাকাগামী পণ্যবাহী আরেক ট্রাকের চালক ইকবাল হোসেন বলেন, ‘ফেরিতে মাইক্রোবাস নেয়, ভিআইপি নেয়, তখন কোনো অসুবিধা হয় না। ট্রাক নিলেই যত সমস্যা। আমার ট্রাকে খাদ্যপণ্য আছে। পাঁচ দিন ধরে আটকা। দু–এক দিনের মধ্যে মাল না নামাতে পারলে মাল ট্রাকেই নষ্ট হওয়ার ভয় আছে। বিষয়গুলো সরকারের দেখা দরকার। পণ্যবাহী ট্রাক পারাপারের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা রাখা উচিত।’
ঘাটে আটকে থাকা ঢাকাগামী অ্যাম্বুলেন্সের চালক মিলন শেখ বলেন, ‘বেলা তিনটা থেকে ঘাটে। কোনো ফেরি নেই। আমি আসার পরে একটি ছোট ফেরিতে লোড নেয়। তখন ছোট গাড়িসহ আরও অ্যাম্বুলেন্স লোড নেওয়ায় সেটায় আমার জায়গা হয় নাই। এই পথে রোগী নিয়ে আইসা খুব বিপদের মধ্যে আছি।’
জানতে চাইলে বাংলাবাজার ঘাটের দায়িত্বরত ট্রাফিক পুলিশের পরিদর্শক (টিআই) জামালউদ্দিন বিকেল সাড়ে পাঁচটায় প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঘাট কর্তৃপক্ষ নতুন সিদ্ধান্ত জানানোর পর থেকে আমরা কোনো ফেরিতে বাস-ট্রাক লোড দিইনি। ট্রাকচালকেরা উত্তেজিত হলেও কিছু করার নেই। আটকে পড়া ভারী গাড়িগুলোকে বিকল্প নৌপথে (দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া) যাওয়ার জন্য বলেছি। কিন্তু তারা যাচ্ছে না। এখানেই পড়ে থেকে দুর্ভোগের শিকার হচ্ছে। বড় ফেরি না চললে আমরা কীভাবে এই গাড়িগুলো লোড দেব। ঘাট খুবই বাজে একটা অবস্থার মধ্য দিয়ে চলছে।’