পিতৃহীন সংসারের অভাব তামান্নুরের স্বপ্নপূরণে বাধা হতে পারেনি
২০১৯ সাল। তামান্নুর আবেদীন তখন কেবল মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। এমন সময় ঝড় নেমে এল পরিবারে। দুটি কিডনি নষ্ট হয়ে যাওয়ায় দীর্ঘ কষ্টভোগের পর মারা গেলেন তাঁর বাবা জয়নাল আবেদীন। এরপর জীবন সংগ্রামে কেটে যায় দুই বছরের বেশি সময়। কিন্তু পিতৃহীন সংসারের অভাব-অনটন তাঁকে লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে এমবিবিএস কোর্সে ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন তামান্নুর। মেধাতালিকায় তাঁর অবস্থান ১২০৫।
তামান্নুর আবেদীনের বাড়ি চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের সৈয়দপুর ইউনিয়নের পূর্ব সৈয়দপুর গ্রামে। তিন বোনের মধ্যে সবার বড় তিনি। মা সখিনা বেগম গৃহিনী। স্বামীর করা অসম্পূর্ণ ভবনে ছোট মেয়ে তানজিম আবেদীনকে নিয়ে থাকেন তিনি। মেজ মেয়ে মিতানুর আবেদীন চট্টগ্রাম সরকারি মহিলা কলেজের হোস্টেলে থাকে। সে ওই কলেজে উচ্চমাধ্যমিকের বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রী।
গত রোববার দুপুরে সৈয়দপুর গ্রামে তাঁদের বাড়িতে কথা হয় তামান্নুর ও তাঁর মা সখিনা বেগমের সঙ্গে। এ সময় সঙ্গে ছিলেন তামান্নুরের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ভূধর দাশ পার্থ।
মেয়ে মেডিকেল কলেজে ভর্তির সুযোগ পাওয়ার আনন্দে ঝলমল করছিল সখিনা বেগমের মুখ। তিনি বলেন, ‘আমার মেয়ে বরাবরই মেধাবী। সাংসারিক এত ঝড়ঝাপ্টা ওকে পড়াশোনা থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। আজ এর ফল পেয়েছে। কিন্তু ওকে তো এগিয়ে যেতে হবে। এখন দুঃশ্চিন্তা সামনের দিনগুলো নিয়ে।’
তামান্নুরের বাবা জয়নাল আবেদীন সিঅ্যান্ডএফ ফার্মে চাকরি করতেন। ভালোভাবেই চলছিল সংসার। তাঁদের একটি সিএনজিচালিত অটোরিকশাও ছিল—যা থেকে সংসারে আয় আসত। কিন্তু ২০০৬ সালে জয়নাল আবেদীনের একটি কিডনিতে সমস্যা দেখা দেয়। ধীরে ধীরে দুটি কিডনিই নষ্ট হয়ে যায়। ২০১৮ সালে ১৪ লাখ টাকা নিয়ে কিডনি প্রতিস্থাপনের জন্য ভারতের ভেলোরে সিএমসি হাসপাতালে যান। একজন কিডনিদাতাও নিয়ে যান। কিন্তু কিডনি প্রতিস্থাপনে খরচ ৩০ লাখ টাকা লাগবে বলে জানিয়েছিলেন চিকিৎসকেরা। তখন তাঁদের কাছে এত টাকা ছিল না। ফলে নিরুপায় হয়ে ফিরে আসেন। এর পর থেকে কিডনি ডায়ালাইসিস করে বেঁচে ছিলেন এক বছর। ২০১৯ সালের এপ্রিলে জয়নাল আবেদীন মারা যান। এরপর সংসারে অর্থ কষ্ট দেখা দেয়।
সেসব দিনের স্মৃতিচারণা করে সখিনা বেগম বলেন, ‘তামান্নুরের বাবা মারা যাওয়ার কয়েক মাস আগের কথা। আমরা তখন নিয়মিতভাবে হাসপাতালে ছোটাছুটি করছিলাম। ঘরে অশান্তির পরিবেশ। কিন্তু মেয়ে ওই অবস্থায়ই এসএসসি পরীক্ষা দেয় এবং জিপিএ-৫ পায়। ওর বাবার মৃত্যুর দুই মাসের মাথায় ওকে চট্টগ্রাম কলেজে ভর্তি করাই। এরপর লেখাপড়ার খরচ, প্রাইভেট শিক্ষকের বেতনসহ আনুসাঙ্গিক খরচ দুশ্চিন্তায় ফেলে দেয়। কারণ, দ্বিতীয় মেয়ে মিতানুর তখন নবম শ্রেণিতে ওঠে। দুই মেয়ের লেখাপড়ার খরচ চালাতে হিমসিম খেতে হচ্ছিল। টাকা-পয়সা যা জমানো ছিল তা–ও স্বামীর চিকিৎসায় শেষ হয়ে গিয়েছিল। আয়ের একমাত্র অবলম্বন ছিল অটোরিকশাটি। কিন্তু সেই টাকায় সংসার খরচ হচ্ছিল না। পরে অটোরিকশা বেচে দেই। এরপর আত্মীয়-পরিজনের সহযোগিতায় তিন মেয়ের পড়াশুনা চালিয়ে নিই।’
বলতে বলতে চোখ ভিজে ওঠে সখিনা বেগমের। তিনি বলেন, তাঁর বোন জরিনা আখতারের চট্টগ্রামের আগ্রাবাদে বাসা ছিল। তামান্নুরকে ওই বাসায় রেখে পড়িয়েছেন। না হলে সীতাকুণ্ড থেকে গিয়ে কিংবা মেয়েকে হোস্টেলে রেখে এই পর্যন্ত আনা সম্ভব ছিল না।
পিএসসি থেকে এইচএসসি পর্যন্ত—সব শ্রেণিতে তামান্নুরের ফলাফল ছিল জিপিএ–৫। পিএসসি, জেএসসিতে টেলেন্টপুলে আর এসএসসিতে সাধারণ গ্রেডে বৃত্তি পেয়েছেন। পূর্ব সৈয়দপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ২০১৩ সালে পিএসসি, এরপর জাফরনগর অপর্ণাচরণ উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করেন তিনি।
তামান্নুর বলেন, ‘বাবার অসুস্থায় আমাকে ভাবিয়ে তুলেছিল। অসুস্থ বাবার কষ্ট দেখেছি। তখন আমার কাছে মনে হতো সমাজে অনেক ভালো চিকিৎসক দরকার। তাঁদের মধ্যে অন্তত একজন হতে চাই আমি। মা সব সময় আমাকে সাহস জুগিয়েছেন। এখন চিকিৎসাবিদ্যায় ভালো ফলাফল করে পড়াশুনা শেষে এলাকার মানুষের পাশে দাঁড়াতে চাই।’
প্রিয় শিক্ষার্থীর এমন সাফল্যে আনন্দিত তামান্নুরের শিক্ষক ভূধর দাশ পার্থও। তিনি বলেন, তামান্নুরেরা তিন বোনই মেধাবী। বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে তিনি তাদের পড়াশুনার খোঁজখবর নিতেন। তামান্নুর স্বল্পভাষী। হাতের লেখা সুন্দর। পরীক্ষায় খাতায় লিখতও নির্ভুল। তামান্নুর ও মিতানুর তাদের বিদ্যালয় থেকে জিপিএ–৫ পেয়ে পাস করেছে। তানজিমও এখন তাদের স্কুলে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। সে–ও জিপিএ–৫ পাবে। তামান্নুর চিকিৎসক হয়ে এলাকায় আলোকিত করবে বলে আশা এই শিক্ষকের।