কারাগার
প্রতীকী ছবি

ঘুষ লেনদেনের ফোনালাপ ফাঁস হওয়ার ঘটনায় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) সেই পরিদর্শক ধনরাজ দাসকে বর্তমান কর্মস্থল থেকে তাৎক্ষণিকভাবে বদলি (স্ট্যান্ড রিলিজ) করা হয়েছে। এ ছাড়া ঘটনা তদন্তে তিন সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত কমিটিকে আগামী সাত কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।

বিষয়টি নিশ্চিত করে নেত্রকোনা পিবিআইয়ের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শংকর কুমার দাশ আজ সোমবার বিকেলে প্রথম আলোকে বলেন, ধনরাজ দাসকে স্ট্যান্ড রিলিজ করা হয়। তাঁর নতুন কর্মস্থল কিশোরগঞ্জে পিবিআই পুলিশে। ধনরাজ দাস আজ সকালে ছাড়পত্র গ্রহণ করে নতুন কর্মস্থলে যোগদানের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছেন।
শংকর কুমার দাশ বলেন, ফোনালাপের বিষয়টি তদন্ত করতে পিবিআই পূর্বাঞ্চলের উপমহাপরিদর্শক (অতিরিক্ত ডিআইজি) মো. সায়েদুর রহমানকে প্রধান করে তিন সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির অন্য দুজন হলেন পিবিআই ময়মনসিংহের পুলিশ সুপার গৌতম কুমার বিশ্বাস ও পিবিআই সদর দপ্তরের সহকারী পুলিশ সুপার মো. আমিনুল ইসলাম।

আরও পড়ুন

পিবিআই কর্মকর্তার ঘুষ লেনদেনের ফোনালাপ ভাইরাল

জানতে চাইলে তদন্ত কমিটির প্রধান অতিরিক্ত ডিআইজি মো. সায়েদুর রহমান মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, পিবিআই প্রধান ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদারের নির্দেশে গঠিত তদন্ত কমিটি ইতিমধ্যে কাজ শুরু করেছে। বিভিন্ন তথ্য–উপাত্ত সংগ্রহ করা হচ্ছে। কমিটির সদস্যরা আগামী বুধবার নেত্রকোনায় এসে সরাসরি সম্পৃক্ত লোকজনদের সঙ্গে কথা বলবে। তদন্তের স্বার্থে এর বেশি কিছু এ মুহূর্তে বলা সম্ভব হচ্ছে না।

ঘটনায় অভিযুক্ত পরিদর্শক ধনরাজ দাসের সঙ্গে বিকেল পাঁচটার দিকে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘আমি জার্নিতে আছি। আপনার কথা বোঝা যাচ্ছে না।’ এ কথা বলে তিনি ফোন কেটে দেন।

ফোনালাপের অডিও ক্লিপে আবুল হোসাইনকে বলতে শোনা যায়, ‘আপনার অফিসে গিয়া আমি টাকা দিয়া আসছি, আপনি এখন আমার বাড়িতে আইসা টাকাটা দিয়া যান।’ জবাবে অপর প্রান্ত থেকে শোনা যায়, ‘আপনি আসেন। মেম্বরকে নিয়ে বসে বিষয়টি শেষ করি। আমার নামে অভিযোগ দিয়ে ক্ষতি করে আপনার কী লাভ হবে? আপনি নেত্রকোনা এসে নিয়ে যান।’

এদিকে ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া ওই ফোনালাপে শোনা যাচ্ছে, একটি ভাঙচুর মামলার আসামিপক্ষের লোকের কাছ থেকে পরিদর্শক ধনরাজ দাস ঘুষ হিসেবে বেশ কিছু টাকা নিয়েছিলেন। কিন্তু কথামতো কাজ না হওয়ায় ঘুষদাতা তাঁর টাকা ফেরত চাচ্ছেন। আর ঘুষগ্রহীতা ধনরাজ দাস নেত্রকোনায় এসে টাকা ফেরত নিয়ে যেতে বলছেন। যিনি টাকা দিয়েছেন বলে দাবি করছেন, তাঁর নাম আবুল হোসাইন।

অভিযোগকারী আবুল হোসাইন প্রথম আলোকে বলেন, ‘ধনরাজ দাস আমাকে আটকিয়ে বিভিন্ন ধরনের ভয়ভীতি দেখিয়ে আমার কাছ থেকে তিন দফায় ১ লাখ ২০ হাজার টাকা ঘুষ নিয়েছেন। এ–সংক্রান্ত সব তথ্য–প্রমাণ আমার কাছে আছে। তাঁকে ঘুষ দিতে আমি বাধ্য হয়েছি। জমি বিক্রিসহ ধারদেনা করে ওই কর্মকর্তাকে ঘুষের টাকা দিতে হয়েছে। আমি টাকা ফেরতসহ ঘটনার বিচার চাই।’

পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ২০১৮ সালের ২০ জুলাই কেন্দুয়ার ডাউকি গ্রামের মসজিদের সামনে থেকে ওই গ্রামের সাবিজ মিয়ার ছেলে জুয়েল মিয়ার লাশ উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় কেন্দুয়া থানায় নিহত জুয়েলের বাবা অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামি করে হত্যা মামলা করেন। পরে ওই মামলা তদন্তের দায়িত্ব পায় পিবিআই। তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় পরিদর্শক আবদুল্লাহ আল মামুনকে। তিনি গত ৪ ডিসেম্বর সাতজনকে আসামি করে আদালতে অভিযোগপত্র দেন।

ধনরাজ দাস আমাকে আটকিয়ে বিভিন্ন ধরনের ভয়ভীতি দেখিয়ে আমার কাছ থেকে তিন দফায় ১ লাখ ২০ হাজার টাকা ঘুষ নিয়েছেন। তাঁকে ঘুষ দিতে আমি বাধ্য হয়েছি। জমি বিক্রিসহ ধারদেনা করে ওই কর্মকর্তাকে ঘুষের টাকা দিতে হয়েছে। আমি টাকা ফেরতসহ ঘটনার বিচার চাই।
আবুল হোসাইন, অভিযোগকারী ব্যক্তি

ছয় দিন পর ১০ ডিসেম্বর ওই মামলার আসামি জিয়াউল ও পলাশের বাড়ি ভাঙচুর, লুটপাটের ঘটনা ঘটে অভিযোগ তুলে তাঁদের ভাই জুলহাস মিয়া গত ২০ জানুয়ারি কেন্দুয়া থানায় মামলা করেন। মামলায় ৭ লাখ ৪৫ হাজার টাকার মালামাল লুট ও ভাঙচুর করার কথা উল্লেখ করে এতে আসামি করা হয় খুন হওয়া জুয়েলের মা ললিতা আক্তার, বোন ডালিয়া আক্তার, ভগ্নিপতি আবুল হোসাইনসহ ছয়জনকে। মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা কেন্দুয়া থানার উপপরিদর্শক (এসআই) নোমান সাদেকীন গত ২ ফেব্রুয়ারি জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ঘটনা মিথ্যা উল্লেখ করে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেন। নোমান সাদেকীনের দেওয়া প্রতিবেদন বাদী প্রত্যাখ্যান করে পুনঃ তদন্তের আবেদন করায় আদালত মামলাটি তদন্তের জন্য পিবিআইকে দায়িত্ব দেন। এবার মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পান পরিদর্শক ধনরাজ দাস। তদন্ত শেষে গত ১৩ এপ্রিল তিনি জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেন। তিনি এবার মিথ্যা মামলা করার বিষয়টি এড়িয়ে উল্লেখ করেন, রাতের আঁধারে মালামাল লুট হওয়ায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কোনো সাক্ষী পাওয়া যায়নি।

পিবিআইয়ের কর্মকর্তা ধনরাজকে ঘুষ দেওয়ার অভিযোগ আনা আবুল হোসাইনের বাড়ি কিশোরগঞ্জের তাড়াইল উপজেলার সেকান্দরনগর গ্রামে। তিনি খুন হওয়া জুয়েল মিয়ার ভগ্নিপতি। ভাঙচুর, লুটপাটের অভিযোগে করা মামলাটির প্রধান আসামি তিনি।

ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া ফোনালাপের অডিও ক্লিপে আবুল হোসাইনকে বলতে শোনা যায়, ‘আপনার অফিসে গিয়া আমি টাকা দিয়া আসছি, আপনি এখন আমার বাড়িতে আইসা টাকাটা দিয়া যান।’ জবাবে অপর প্রান্ত থেকে শোনা যায়, ‘আপনি আসেন। মেম্বরকে নিয়ে বসে বিষয়টি শেষ করি। আমার নামে অভিযোগ দিয়ে ক্ষতি করে আপনার কী লাভ হবে? আপনি নেত্রকোনা এসে নিয়ে যান।’ তখন আবুল বলেন, ‘আমি নেত্রকোনা আসতে ভয় পাই। আমি টাকা দিয়েছি, আপনি টাকা নিয়েছেন। আমার টাকা বাড়িতে এসে ফেরত দিয়ে যান।’ এভাবেই ৯ মিনিট ২৬ সেকেন্ডের অডিও রেকর্ডে উঠে আসে ঘুষের টাকার লেনদেনের বিষয়টি।

এ নিয়ে গতকাল রোববার প্রথম আলো অনলাইন সংস্করণে ‘পিবিআই কর্মকর্তার ঘুষ লেনদেনের ফোনালাপ ভাইরাল’ শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।