পুলিশে চাকরি হয়েছে চন্দ্রিকার, মাকে আর বিদেশে কাজ করতে হবে না
যখন বুঝতে শিখেছেন, তখন থেকেই পুলিশ হওয়ার ইচ্ছা ছিল চন্দ্রিকা রানীর। আড়াই বছর বয়সে বাবাকে হারান। বড় হয়েছেন নানার বাড়িতে। ১০ বছর বয়সে গৃহকর্মীর কাজ নিয়ে সৌদি আরবে যান তাঁর মা স্মৃতি রানী। গত ১০ বছরে চন্দ্রিকা মায়ের সঙ্গে থাকতে পেরেছেন মাত্র তিন মাস। বর্তমানে ওমানে একটা আতর কোম্পানিতে কাজ করেন মা। পুলিশ কনস্টেবল পদে চাকরি পেয়েছেন চন্দ্রিকা। চাকরি পেয়ে মাকে ফোন দিয়ে কাজ থেকে ইস্তফা দিতে বলেছেন। মাকে দেশে ফিরিয়ে আসতে বলেছেন। মাকে এবার নিজের মতো করে কাছে পাবেন—বলতে বলতে গলা ধরে আসে তাঁর।
১০ এপ্রিল পুলিশের নিয়োগ পরীক্ষায় চূড়ান্তভাবে উত্তীর্ণ হয়েছেন চন্দ্রিকা। চূড়ান্তভাবে উত্তীর্ণ হলেও তাঁর স্থায়ী ঠিকানা খুঁজে পেতে বিড়ম্বনায় পড়ে পুলিশ কর্তৃপক্ষ। চন্দ্রিকার আবেদনপত্রে স্থায়ী ঠিকানা লেখা ছিল দিনাজপুরের বিরল উপজেলা। কিন্তু ঠিকানা অনুযায়ী পুলিশ চন্দ্রিকাকে সেখানে খুঁজে পায়নি। পুলিশ লাইনসে উত্তীর্ণদের পরিচিতি অনুষ্ঠানে চন্দ্রিকার কাছে পুলিশ জানতে পারেন, তাঁর জন্ম বিরামপুরে, থাকতেন শহরের চাউলিয়াপট্টি এলাকার একটি ভাড়া বাসায়। বিরল উপজেলায় তিন শতক জমি কিনলেও বাড়ি করতে পারেননি। এ জন্য স্থায়ী ঠিকানায় বিরল লিখেছিলেন চন্দ্রিকা।
এইচএসসি পড়ার সময় জাতীয় মহিলা সংস্থা থেকে কম্পিউটার প্রশিক্ষণ নিয়ে সেখানেই খণ্ডকালীন চাকরি শুরু করেন চন্দ্রিকা। পাশাপাশি শিখেছেন দরজির কাজ, হারমোনিয়াম বাজানো। দিগন্ত শিল্পী গোষ্ঠী থেকে নৃত্যচর্চাও রপ্ত করেছেন। জেলার বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশ নেন তিনি।
চন্দ্রিকা বর্তমানে দিনাজপুর শহরের নিমতলা এলাকায় নানার ভাড়া বাড়িতে থাকেন। গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ওই বাড়িতে গিয়ে চন্দ্রিকার সঙ্গে কথা হয়। পাশে বসে ছিলেন চন্দ্রিকার নানা কিশোর কুমার মহন্ত। জানালেন, নবম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় মেয়ে স্মৃতি রানীর (চন্দ্রিকার মা) বিয়ে দিয়েছিলেন বিরামপুরে। জামাই চঞ্চল মণ্ডল পেশায় ছিলেন ট্রাকচালক। বিয়ের চার বছরের মাথায় ২০০৫ সালে জামাতা মারা গেলে নাতি-নাতনি ও মেয়েকে নিজের কাছে নিয়ে আসেন। বাড়ির পাশে মুদিদোকান শুরু করেন মেয়ে স্মৃতি রানী। সংসারে অভাব–অনটনের মধ্যে মেয়ের পড়ালেখা করার ইচ্ছা। উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করে একটি বেসরকারি সংস্থায় (এনজিও) মাঠকর্মীর কাজ নেন। চন্দ্রিকা তৃতীয় শ্রেণিতে থাকতে স্থানীয় এক ব্যক্তির সহযোগিতায় প্রথমে সৌদি আরবে যান।
মায়ের মতোই সংগ্রাম করতে শিখেছেন চন্দ্রিকা। দিনাজপুর উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি, সরকারি মহিলা কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে বর্তমানে সেতাবগঞ্জ সরকারি কলেজে ব্যবসায় শিক্ষা বিষয়ে অনার্স পড়ছেন। এইচএসসি পড়ার সময় জাতীয় মহিলা সংস্থা থেকে কম্পিউটার প্রশিক্ষণ নিয়ে সেখানেই খণ্ডকালীন চাকরি শুরু করেন। পাশাপাশি শিখেছেন দরজির কাজ, হারমোনিয়াম বাজানো। দিগন্ত শিল্পী গোষ্ঠী থেকে নৃত্যচর্চাও রপ্ত করেছেন। জেলার বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশ নেন তিনি। নিজের আয়ে নিজেই চলছেন।
চন্দ্রিকা প্রথম আলোকে বলেন, মহিলা সংস্থার ক্লাসে তাঁর এক শিক্ষার্থীর কাছে পুলিশ কনস্টেবল পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির কথা জানতে পারেন। পরের দিনই আবেদন করেন। তারপর পরিচিত একজনের কাছে জানতে পারেন, পুলিশের নিয়োগ পরীক্ষায় ব্যবহারিক পরীক্ষা অনেক কঠিন। দৌড়ানোসহ নানা বিষয়ে উত্তীর্ণ হওয়ার পর সুযোগ পাওয়া যায়। পরের দিন থেকে শহরের শিশুপার্কে প্রতিদিন সকাল থেকে অনুশীলন শুরু করেন। এ ক্ষেত্রে শিশুপার্কের স্কেটিং প্রশিক্ষক নুরুল ইসলাম তাঁকে সহযোগিতা করেন। ব্যবহারিক পরীক্ষায় ১ হাজার মিটার দৌড়, পুশআপ, হাইজাম্প, লংজাম্প, ড্রাগিং, র্যাপিংসহ বিভিন্ন পরীক্ষায় সাফল্যের সঙ্গে উত্তীর্ণ হন।
চন্দ্রিকা বলেন, ‘নানার বাড়িতে খুব অভাব–অনটনের মধ্যে বড় হয়েছি। প্রায় সময় সকালে না খেয়ে স্কুলে যেতে হয়েছে। উপার্জনের চিন্তা ছোট থেকেই ছিল। এইটুকু জীবনে অবসর কী জিনিস, বুঝিনি। সব সময় কোনো না কোনো কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকার চেষ্টা করেছি। অনেকের কাছে শুনেছি, পুলিশে চাকরি পেতে টাকা লাগে। এ ধারণা ভুল প্রমাণ করে নিজের যোগ্যতা ও মেধায় চাকরি পেয়েছি। চাকরির খবর শুনে মা, নানা, মামা, মামি অনেক খুশি হয়েছেন। চাকরি করার সময় পড়ালেখার সুযোগ পাব কি না, জানি না। কিন্তু অনার্সটা অন্তত শেষ করতে চাই।’
চন্দ্রিকার ব্যাপারে দিনাজপুরের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, সব পরীক্ষায় চন্দ্রিকা সাফল্যের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়েছেন। লিখিত পরীক্ষায় খুবই ভালো ফল করেছেন তিনি। আবেদনপত্রে তাঁর দেওয়া স্থায়ী ঠিকানা মিলছিল না। পরের দিন ওরিয়েন্টেশন পর্বে তাঁর বিষয়ে সব জানতে পেরেছেন। পুলিশে চাকরি করা অবস্থায়ও পড়ালেখার সুযোগ আছে। তিনি চাইলে পড়ালেখা চালিয়ে যেতে পারবেন।