পেট চালাতে কাজের খোঁজে রাস্তায় নেমেছেন তাঁরা

লকডাউনে কক্সবাজারের হোটেল, মোটেল, রেস্তোরাঁ বন্ধ হওয়ায় চাকরি হারিয়ে কাজের সন্ধানে নেমেছেন এই নারীরা
ছবি: প্রথম আলো

কক্সবাজার সৈকতের কলাতলী হোটেল মোটেল এলাকা। শনিবার সকাল ১০টা। সুগন্ধা সড়কের পাশে বন্ধ ‘ধানসিঁড়ি’ রেস্তোরাঁ। তার পাশে একটি আবাসিক হোটেলের ফটকের সামনে একলা বসে কী যেন ভাবছেন বোরকা পরা এক নারী।

এগিয়ে গিয়ে নাম জানতে চাইলে বলেন, সামসুন্নাহার। বসে আছেন কেন? সামসুন্নাহারের (৫০) জবাব, ‘এক মাস ধরে আয়–রোজগার নেই, ঠিকমতো চুলাও জ্বলছে না। এত দিন ধারকর্জ করে চলেছি, সামনে ঈদ। ঘরভাড়াও বাকি। টাকাপয়সার খুব দরকার। তাই কাজের সন্ধানে বসে আছি।’

সামসুন্নাহারের বাড়ি রামু উপজেলার চেইন্দা কাইম্যারঘোণা এলাকায়। ২২ বছর আগে স্বামী মোজান্মেল হক মারা গেলে ছোট ছোট তিন ছেলেমেয়েকে নিয়ে বেকায়দায় পড়েন তিনি। সংসার থেকে বেরিয়ে নেমে পড়েন কাজের সন্ধানে। দুই ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে চলে আসেন কক্সবাজার শহরের কলাতলী গ্রামে। টানা ১১ বছর তিনি এই এলাকার একটি গেস্টহাউসে মাসে ৫ হাজার ৫০০ টাকা বেতনে চাকরি করছেন।

নিজের আয় দিয়েই চালিয়ে নিচ্ছিলেন সংসার। কয়েক বছর আগে দুই ছেলে ‘ঘরজামাই’ হয়ে অন্যত্র চলে গেছেন। ধারদেনায় দেড় বছর আগে বিয়ে দেন একমাত্র মেয়েকে। এখন কলাতলীর ছোট্ট একটি টিনের ঘরে একাকী বসবাস কর্মজীবী এই নারীর।

মাসে সাড়ে পাঁচ হাজার টাকায় চলতেন কীভাবে, জানতে চাইলে সামসুন্নাহার বলেন, যে ঘরে থাকেন তার মাসিক ভাড়া ১ হাজার ২০০ টাকা। বেতনের বাকি টাকা হোটেল থেকে বাসায় আসা–যাওয়াতেই খরচ হয়ে যায়। পেট চলে গেস্টহাউসের অতিথিদের বকশিশের টাকায়।

সামসুন্নাহার জানান, হোটেলকক্ষ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন দেখলে অতিথিরা বকশিশ দেন। তা থেকে দিনে ২০০-৩০০ টাকাও হয়ে যেত। এখন তো কেউ নেই, হোটেল, মোটেল, রেস্তোরাঁগুলোও বন্ধ, বন্ধ হয়ে গেছে আয়–রোজগারও।

‘কিন্তু পেট তো আর এসব বোঝে না। তাই কাজের সন্ধানে মাঠে নেমেছি। গত তিন দিনে বিভিন্ন জায়গায় খোঁজ নিয়েও কাজ মেলেনি। এখন কী করব ভেবে পাচ্ছি না।’

করোনাভাইরাসের বিস্তার রোধে চলমান বিধিনিষেধের কারণে গত ১ এপ্রিল থেকে বন্ধ রয়েছে পর্যটন নগরী কক্সবাজারের পাঁচ শতাধিক হোটেল, মোটেল, গেস্টহাউস, রেস্তোরাঁ। এতে কর্মহীন হয়ে পড়েছেন সেবা খাতের এসব প্রতিষ্ঠানের হাজার হাজার কর্মচারী।

সামসুন্নাহার
ছবি: প্রথম আলো

কক্সবাজারে হোটেল, মোটেল বন্ধ হওয়ায় কতজন নারী চাকরি হারিয়েছেন, তার সঠিক তথ্য কারও কাছে নেই। তবে হোটেল, মোটেল, রেস্তোরাঁর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সংগঠন কক্সবাজার হোটেল মোটেল গেস্টহাউস অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের তথ্যমতে, লকডাউন পরিস্থিতিতে পাঁচ শতাধিক আবাসিক হোটেল-গেস্টহাউস এবং দুই শতাধিক রেস্তোরাঁ বন্ধ হয়েছে। আর এতে চাকরি হারিয়েছেন অন্তত ৩০ হাজার মানুষ। তাঁদের মধ্যে কর্মজীবী নারীর সংখ্যা প্রায় পাঁচ হাজার।

অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক করিম উল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, ওই ৩০ হাজার কর্মচারীর মধ্যে অন্তত ২৮ হাজারের চাকরিতে নিয়োগ হয়েছিল মৌখিকভাবে। তাঁদের নিয়োগপত্রও ছিল না। ছাঁটাই করা হয়েছে মৌখিকভাবে। নিয়োগপত্র না থাকায় তাঁদের পক্ষে জোরালোভাবে কথাও বলা যাচ্ছে না।

করিম উল্লাহ বলেন, ছাঁটাই হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে অর্ধেকের মতো গত মার্চ মাসের বেতন পেয়েছেন। এরপর আর কাউকে এপ্রিল–মে মাসের বেতন দেওয়া হচ্ছে না।
‘আমরা হোটেলমালিকদের কাছে দাবি জানিয়ে আসছি, ঈদের আগেই যেন সব কর্মচারীর এপ্রিল ও মে মাসের বেতন এবং ঈদের বোনাস পরিশোধ করা হয়। কিন্তু কেউ আমলে নিচ্ছেন না।’

এই পরিস্থিতিতে সামসুন্নাহারের মতো হাজারো নারী এখন টিকে থাকার লড়াইয়ে বেকায়দায় পড়েছেন। শনিবার দুপুরেও তাঁর মতো আরও ছয়-সাতজন কর্মজীবী নারীকে দেখা যায় সৈকতের কলাতলীর হোটেল–মোটেলের ফাঁকা সড়কে ঘোরাফেরা করে কাজের সন্ধান করতে। তবে অধিকাংশ দিনই খালি হাতে বাড়ি ফিরতে হচ্ছে তাঁদের।

দুপুরে সুগন্ধা হোটেলের নিচের গলিতে দেখা হয় কাজের সন্ধানে আসা আরেক কর্মজীবী নারী ৪৮ বছর বয়সী রাজিয়া বেগমকে। তাঁর বাড়ি কক্সবাজার সদর উপজেলার ঝিলংজা এলাকায়। থাকেন শহরের কলাতলী গ্রামের এক বস্তিতে, ভাড়া বাসায়। ঘরে তাঁর অসুস্থ স্বামী এবং ১৬ বছর বয়সী এক কিশোরী মেয়ে।

রাজিয়া বেগম জানান, তিনিও মাসে পাঁচ হাজার টাকা বেতনে একটি আবাসিক হোটেলে পরিচ্ছন্নতাকর্মীর কাজ করতেন। গত ১ এপ্রিল হঠাৎ তাঁকে চাকরি থেকে ছাঁটাই করা হয়। এপ্রিল মাস থেকে বেতনও বন্ধ। রোজগার বন্ধ থাকায় ঘরে তাঁর ৭০ বছর বয়সী অসুস্থ স্বামীর ওষুধ কিনতে পারছেন না। সংসার চালাতেও তাঁকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। এখন পর্যন্ত সরকারি–বেসরকারি কোনো সহযোগিতাও পাননি।
‘আমরা কি না খেয়ে মরব’, কাতর স্বরে প্রশ্ন করেন এই নারী।

রাজিয়া বেগম

সামসুন্নাহার ও রাজিয়া বেগমের মতো দুর্দশায় পড়ার কথা জানালেন আরেক গৃহবধূ শিউলী আকতার। কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের মেয়ে শিউলী স্বামী ও তিন ছেলেমেয়ে নিয়ে থাকেন কক্সবাজার শহরের ঝাউতলা গাড়ির মাঠ এলাকায়। মাসে ১৭ হাজার টাকা বেতনে তিনি চাকরি করতেন সৈকতের একটি আবাসিক হোটেলে। গত ১ এপ্রিল থেকে হোটেল বন্ধ হওয়ায় তাঁর চাকরিও নেই। শিউলী আকতার বলেন, দুই মাসের বাসাভাড়া বাকি, ধারকর্জ করে কোনোরকমে সংসার চালাচ্ছেন। সামনে কী হবে, তা ভেবে পাচ্ছেন না।

এই নারীদের মতো আরও অনেক পরিবারেই এখন চলছে টিকে থাকার লড়াই। শহরের কলাতলীর একটি গেস্টহাউসে কয়েক বছর ধরে চাকরি করছেন নোয়াখালীর সাব্বির আহমদ (৪৫)। স্ত্রী ও চার সন্তান নিয়ে তিনি থাকেন শহরের তারাবনিয়ারছড়া এলাকার ভাড়া বাসায়।

হঠাৎ চাকরি হারিয়ে দিশেহারা সাব্বির আহমদ বলেন, গত মার্চের বেতন ১৯ হাজার টাকা ধরিয়ে দিয়ে তাঁকে বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠানো হয়। সেই টাকা দিয়ে এপ্রিল মাসটা কোনোমতে চলেছেন। কিন্তু এপ্রিলের বেতন না পাওয়ায় মে মাস কাটছে চরম সংকটে। এক দিকে দুই মাসের বাসাভাড়া বাকি, অন্যদিকে ঈদ। সন্তানদের চেহারা দেখলে চোখে জল নেমে আসে। কী করবেন ভেবে পাচ্ছেন না।

কর্মচারীদের বেতন পরিশোধ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কক্সবাজার কলাতলী মেরিন ড্রাইভ হোটেল রিসোর্ট মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মুকিম খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা মানবিক দিক বিবেচনা করে গত শুক্রবার নোটিশ দিয়ে সব মালিককে বলেছি যেন ঈদের আগেই যেন সব কর্মচারীর এপ্রিল ও মে মাসের বেতন পরিশোধ করেন।’

সুগন্ধা এলাকার বৈশাখী রেস্তোরাঁর মালিক কামরুল ইসলাম বলেন, পর্যটক থাকলে রেস্তোরাঁয় বেচাবিক্রি ভালো হয়। তখন রেস্তোরাঁর ২৯ জন কর্মচারীর মাসিক বেতন ২ লাখ ৭৩ হাজার টাকা পরিশোধ করতে গায়ে লাগত না। এখন কর্মচারীদের বেতন দূরের কথা, বিদ্যুৎ খরচ পরিশোধের “সামর্থ্যও নেই”।