তিন বছর আগে চার লাখ টাকা খরচ করে মুরগির খামার গড়ে তোলেন রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার প্রামাণিকপাড়া গ্রামের রিফাত ইসলাম। স্বপ্ন ছিল নিজের গড়া খামারে মুরগি পালন করে স্বাবলম্বী হবেন। কিন্তু প্রথম বছরেই করোনার কারণে ধাক্কা খায়। লোকসান গুনতে হয় দুই লাখ টাকা।
ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টায় পরের বছরও মুরগি পালন করেন তিনি। কিন্তু কিছুতেই আলোর মুখ দেখতে পারছেন না। খুচরা বাজারে দাম থাকলেও মধ্যস্বত্বভোগীর কারণে একের পর এক লোকসান গুনতে হচ্ছে তাঁকে। এবারও মুরগি বিক্রি করে ১ লাখ ১৫ হাজার টাকা লোকসান হয়েছে তাঁর।
রিফাত ইসলাম বলেন, বর্তমানে শ্রম–অর্থ—দুটিতেই লোকসান খামারিদের। আর লাভ দালাল ও খুচরা বিক্রেতাদের। এক বছরে ব্যবধানে প্রতি বস্তা ফিডে ৮৫০-৯৫০ টাকা বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু পাইকারি বাজারে দুই মাসের ব্যবধানে জাতভেদে মুরগির দাম কেজিতে কমেছে ৭০-৮০ টাকা। এবারেই দুই হাজার ব্রয়লার মুরগিতে ১ লাখ ১৫ হাজার টাকা লোকসান দিতে হয়েছে।
পোদ্দারপাড়া গ্রামের তরুণ স্বপ্ন মিয়াও স্বপ্ন দেখেছিলেন খামার করে কিছু করার। কিন্তু সেই স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে গেছে। দুই মাস আগে তাঁর পুরো খামারের মুরগি মারা গেছে। ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য আবার এক হাজার ব্রয়লার মুরগি পালন করলেও উৎপাদিত খরচের চেয়ে কেজিতে ২৭-৩০ টাকা কম দরে বিক্রি করতে হয়েছে।
স্বপ্ন মিয়া বলেন, ‘ভাই, এক কেজি ব্রয়লার মুরগি বিক্রয়ের উপযোগী হয় ৩০-৩৫ দিনে। এ সময়ে কেজিতে উৎপাদন খরচ পড়েছে ১১৭ টাকা। পাইকার সেই মুরগি কিনে নিয়ে যাচ্ছেন ৯০-৯৫ টাকায়। খুচরা বাজারে এই মুরগি বিক্রি হচ্ছে ১৪০-১৪৫ টাকা। ৩০-৩৫ দিন মুরগি পুষে খামার করে লোকসান কেজিতে ২২-২৭ টাকা। আর এক দিনেই ব্যবসায়ীরা কেজিতে লাভ করছেন ৫০-৫৫ টাকা।’
শুধু রিফাত ও স্বপ্ন মিয়াই নন, তারাগঞ্জের পোলট্রিখামারিরা এবার নিম্ন বাজারদরে বড় লোকসানের মুখে পড়েছেন।
কয়েকজন খামারির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঈদ ঘিরে এবারে অধিকাংশ খামারিই মুরগি পালন করেছেন। প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরিগ উৎপাদন খরচ ১১৭-১২০ টাকা, সোনালি মুরগির উৎপাদন খরচ প্রতি কেজিতে পড়েছে ২২৫-২২৭ টাকা। কিন্তু খামারির কাছ থেকে পাইকার ও ব্যবসায়ীরা ব্রয়লার মুরগি কিনছেন ৯০-৯৫ টাকা ও সোনালি মুরগি ১৭০-১৮০ টাকায়। আর খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ১৪০-১৪৫ ও ২৭০-২৮০ টাকায়। গত ছয় মাসে তিন দফায় প্রতি বস্তা ফিডে প্রকারভেদে ৮৫০-৯৫০ টাকা বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে উৎপাদন খরচ বেড়েছে। বাজারে সেই অনুযায়ী দাম না থাকায় বিক্রয়ের উপযোগী মুরগি নিয়ে বিপাকে পড়েছেন খামারিরা। বাধ্য হয়েই অনেককে মোটা অঙ্কের লোকসান গুনতে হচ্ছে।
উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, উপজেলার পাঁচটি ইউনিয়নে নিবন্ধিত অনিবন্ধতি পোলট্রি খামারের সংখ্যা ২১০। এসব খামারে উৎপাদিত মুরগি স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে আশপাশের জেলাসহ ঢাকা শহরেও যায়। বন্যা পরিস্থিতিতে এবার বাইরে মুরগির চাহিদা কম থাকায় বাজারদর পড়ে যায়। ফলে ক্ষুদ্র খামারিরা লোকসানের মুখে পড়েছেন।
পোদ্দারপাড়া গ্রামের সোনালি মুরগির খামারি হামিদুল ইসলাম বলেন, ‘টাকা আমার, শ্রম আমার, নিদ–ঘুম হারাম করে মুরগি বড় করি আমরা। আর মাস শেষে লাভ খায় ফড়িয়ারা। দেশটাত দালাল ছাড়া কোনো কিছু করা যাওছে না। খামার আসি মুরগি হাতবদল করি দেওছে কেজিতে পাঁচ টাকা পাওছে দালালেরা।’
বামনদীঘি গ্রামের তরুণ খামারি নাহিদ বাবু বলেন, ‘ভাই খামারে হারভাঙা পরিশ্রম। ৬০ দিনে সোনালি মুরগি বিক্রয়ের উপযোগী হয়। আমার খামারের মুরগি বিক্রয়ের উপযোগী হয়ে গেছে। পাইকাররা প্রতি কেজি মুরগি ১৭০ টাকা দর করছেন, যেখানে আমার খরচ পড়েছে ২২৬ টাকা। হিসাব করে দেখেছি, এই পর্যায়ে মুরগি বিক্রি করলে মোটা অঙ্কের লোকসান যাবে। মুরগি নিয়ে ধুঁকে ধুঁকে মরছেন আমার মতো অনেক খামারি।’
উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ফরহাদ নোমান বলেন, বিভিন্ন এলাকায় বন্যা হওয়ায় সেসব এলাকার খামারিরা তাঁদের উৎপাদিত মুরগি কম মূল্যে বিক্রি ও এ অঞ্চলের মুরগি বাইরে না যাওয়ায় বাজারদর কমে গেছে। এ ছাড়া খাদ্যের দাম বাড়ায় উৎপাদন খরচও বেড়েছে। ফলে খামারিরা ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না।