অদম্য মেধাবী
প্রতিকূলতা ওদের দমাতে পারেনি
নানা কষ্ট আর দুর্দশা মোকাবিলা করে সাফল্যের মুখ দেখেছে তারা। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে উঠে আসা অদম্য মেধাবীদের গল্প থাকছে আজ।
দারিদ্র্যের কারণে জীবনসংগ্রামের কঠিন পথ বেছে নিতে হয়েছে তাদের। রিকশা চালানো, দিনমজুরি, টিউশনি করে পড়ালেখা চালিয়ে গেছে। অদম্য ইচ্ছার কাছে হার মেনেছে শত প্রতিকূলতা। এই অদম্য মেধাবীরা এবারের এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। পড়ুন এমন পাঁচ শিক্ষার্থীর জীবনসংগ্রামের গল্প।
‘ওক পড়ার টাকা মুই কোনটে পাইম’
‘মেলা দিনেই মেয়েটা মোর খালি পেটে স্কুল গেইছে। শুনুছুং ওয় ভালো রেজাল্ট করচ্ছে। শুনি বুকটা ফাটি যাওছে। কিন্তু ওক পড়ার টাকা মুই কোনটে পাইম।’
ইনুফা আক্তারের জিপিএ–৫ পাওয়ার খবরে এভাবেই বলছিলেন তাঁর মা বিউটি বেগম।
রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার ঘনিরামপুর ঝাঁকুয়াপাড়া গ্রামে ইনুফাদের বাড়ি। তারা তিন ভাই–বোনই পড়াশোনা করছে। কিন্তু বাবা ইউনুস আলী নদীতে মাছ ধরে যে আয় করেন, তা দিয়ে দুই বেলার খাবার জোটে না। মা অন্যের বাড়িতে কাজ করেন। পড়ার খরচ জোগাতে ইনুফা তাই গ্রামের অন্য শিশুদের পড়িয়েছে।
ইনুফা বলে, ‘আমার ইচ্ছে একজন সৎ কর্মকর্তা হওয়ার। জানি না এ স্বপ্ন পূরণে কতটুকু সফল হব।’
‘বাবার রিকশা আমি নিজে চালিয়েছি’
সহায়সম্বল বলতে বসতভিটার দেড় শতক জমি আর একটি টিনের দোচালা ঘর। আমিনুর রহমানের রিকশার চাকা ঘুরলে পরিবারের সবার জোটে ভাত, না হলে অনাহারে দিন কাটে। দুই বছর আগে দুর্ঘটনায় আমিনুর কোমরে আঘাত পায়। এরপর থেকে তেমন রিকশা চালাতে পারেন না।
পড়াশোনার খরচ জোগাতে বাবার রিকশা চালানো শুরু করে রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার কিসামত মেনানগর বড়বাড়ি গ্রামের মফিজার রহমান। এর মধ্যেই এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেলেও কলেজে পড়ার খরচ নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন মফিজার।
মফিজার রহমান বলে, ‘বাবা সারা দিন রিকশা টানতে পারেন না। বাবার রিকশা আমি নিজে চালিয়েছি। আমার ইচ্ছা, পড়ালেখা করে ডাক্তার হব।’
‘এরপর কী করব বলতে পারছি না’
ছোটবেলায় বাবাকে হারিয়েছে শাহিনুর রহমান। ছেলেকে লেখাপড়া করাতে সরকারি শিশু পরিবারে ভর্তি করে দেন মা। সেখানে থেকে পড়াশোনা করেই এবারের এসএসসি পরীক্ষায় নীলফামারী সরকারি উচ্চবিদ্যালয় থেকে সব বিষয়ে জিপিএ-৫ (গোল্ডেন) পেয়েছে সে।
শাহিনুরদের বাড়ি নীলফামারীর জলঢাকা উপজেলার পূর্ব খুটামারা চেয়ারম্যানপাড়া গ্রামে। সরকারি শিশু পরিবারে থেকে তার বড় ভাই শাহীন মিয়াও এসএসসিতে জিপিএ–৫ পেয়েছিলেন।
শাহিনুর বলে, ‘১৮ বছর বয়সের পর সরকারি শিশু পরিবারে কেউ থাকতে পারেন না। লেখাপড়ার শেষ আশ্রয় থেকে আমাকেও চলে যেতে হবে। এরপর আমি কী করব বলতে পারছি না।’
‘ছেলেটার লেখাপড়ায় দারুণ আগ্রহ’
অর্থভাবে কোচিংয়ে পড়িয়ে নিজে লেখাপড়া করে এবার এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ–৫ পেয়েছে শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলার নয়াবিল পূর্বপাড়া গ্রামের মেহেদী হাসান। তাঁর বাবা বিল্লাল হোসেন কাঠমিস্ত্রির কাজ করেন। যা আয় করেন, তা দিয়ে পাঁচ সদস্যের সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হয় তাঁকে।
মেহেদী বলে, ‘আমি প্রকৌশলী হওয়ার স্বপ্ন দেখি। বাবা যা আয় করেন, তা দিয়ে ঠিকমতো সংসার চলে না। স্কুলের স্যারদের মাধ্যমে কোচিংয়ে ক্লাস নেওয়ার সুযোগ পাই। এতে বাবার ওপর লেখাপড়ার খরচের চাপ কিছুটা হালকা হয়েছে।’
বিল্লাল হোসেন বলেন, ‘ছেলেটা এখন কলেজে ভর্তি হয়েছে। কিন্তু হাতে কোনো টাকাপয়সা না থাকায় কলেজেও টাকা দিতে পারি নাই।’
‘কলেজে ভর্তি করান লাগে, কিন্তু হাতে টাকা নাই’
একটি ঘরে গাদাগাদি হয়ে চৌকিতে বসে লেখাপড়া করতে হয়েছে। খেয়ে না খেয়ে, প্রাইভেট ছাড়াই চালিয়ে গেছে লেখাপড়া। এর মধ্যেই এবার এসএসসি পরীক্ষায় সব বিষয়ে জিপিএ-৫ পেয়েছে শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলার বালুঘাটা গ্রামের মাসকুরা জাহান।
মাসকুরার বাবা হাবিবুল্লাহ অটোরিকশাচালক। তাঁর সামান্য আয়ে পাঁচ ছেলেমেয়ের লেখাপড়া ও সংসার চলে। সন্তানদের সাফল্য দেখে স্থানীয় সমিতির মাধ্যমে ৮০ হাজার টাকা ঋণ করেছেন।
হাবিবুল্লাহ বলেন, ‘মাসকুরারে কলেজে ভর্তি করান লাগে কিন্তু হাতে কোনো টাকাপয়সা নাই। নতুন কলেজ, নতুন কোনো জামাকাপড়ও কিইনা দিবার পাইছি না। বাবা হিসেবে ভীষণ কষ্ট লাগে।’
[প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়েছেন রহিদুল মিয়া, তারাগঞ্জ, রংপুর, মীর মাহমুদুল হাসান, নীলফামারী, আবদুল মান্নান, নালিতাবাড়ী, শেরপুর]