কীর্তনখোলা নদীর তীরে গড়ে তোলা বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় আজ মঙ্গলবার এক যুগে পদার্পণ করেছে। ১১ বছর নানা চড়াই-উতরাই আর সীমাবদ্ধতার মধ্য দিয়ে বেড়ে ওঠা বিশ্ববিদ্যালয়টির ক্যাম্পাসটি মনোমুগ্ধকর হলেও কাটেনি নানা সংকট। শিক্ষার্থীরা বলছেন, এখনো পূর্ণাঙ্গতা পায়নি বিশ্ববিদ্যালয়টি। এসবের মধ্যেই পড়াশোনা চালিয়ে নিতে হচ্ছে। বেশি ভোগাচ্ছে আবাসন, ক্লাসরুম, শিক্ষক, পরিবহন ও গ্রন্থাগারে বইয়ের সংকট।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৩ সালে এ অঞ্চলে একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের ঘোষণা দিয়েছিলেন। পরে তা আর বাস্তবায়ন হয়নি। দীর্ঘ সংগ্রামের পর ২০০৯ সালে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় আইন সংসদে পাস হয়। ২০১১ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের দীর্ঘদিনের দাবি বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন।
প্রতিষ্ঠার পর থেকে নানা সীমাবদ্ধতার মধ্য দিয়ে এগোচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়। শিক্ষার্থীরা বলছেন, ৯ হাজার শিক্ষার্থীর মধ্যে আবাসন সুবিধা আছে হাজারখানেক শিক্ষার্থীর। তা–ও এক শয্যায় দুজন থেকে। বাকিদের বাইরে থাকতে হচ্ছে। শুরু থেকেই পাঠদান কক্ষসংকট তো আছেই। একটি ক্লাসরুমে দুটি বিভাগকে ভাগাভাগি করে পাঠদান করাতে হচ্ছে। এটা তাঁদের জন্য খুব বিড়ম্বনার।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন জানায়, বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে ছয়টি অনুষদের অধীনে ২৪টি বিভাগ রয়েছে। ছাত্রদের জন্য পাঁচতলাবিশিষ্ট দুটি ও ছাত্রীদের জন্য পাঁচতলা ও ছয় তলাবিশিষ্ট দুটি হল রয়েছে। শিক্ষার্থীদের যাতায়াতের সুবিধার জন্য ১৮টি বাস।
৯ হাজারের বেশি শিক্ষার্থীদের জন্য এসব সুবিধা খুবই অপ্রতুল। হলগুলোতে এক হাজার শিক্ষার্থী থাকতে পারলেও বাকিদের বাইরে মেসে থাকতে হচ্ছে। এ জন্য তাঁদের ব্যয় যেমন বেড়েছে তেমনি বেড়েছে নিরাপত্তাহীনতা। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর কমিটি না থাকলেও ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের প্রভাব বিস্তার, কোন্দলে নীরব শিকার হচ্ছে সাধারণ শিক্ষার্থীরা।
বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর অনুপাতে শিক্ষকস্বল্পতা রয়েছে। অধ্যাপক আছেন মাত্র একজন, সহযোগী অধ্যাপকের সব পদই শূন্য। নেই সহ–উপাচার্য, স্থায়ী রেজিস্ট্রার, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক, ট্রেজারারসহ পাঁচটি অনুষদের ডিন।
গ্রন্থাগারে পর্যাপ্ত বই না থাকার বিষয়টি তুলে ধরে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের স্নাতকোত্তর শ্রেণির শিক্ষার্থী সফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের চার বছরে ৩২টি কোর্স করতে হয়। এসব কোর্সের অধিকাংশ বই আমাদের গ্রন্থাগারে নেই। অনলাইনে বিদেশি জার্নাল ঘেঁটে পড়াশোনো করতে হয়। ইন্টারনেটের বিভিন্ন আর্টিকেলই একমাত্র রিসোর্স।’
গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী ফারিয়া জাহান ও অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী তিশা রহমানের বলেন, কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাফল্য থাকলেও অনেক সংকট রয়ে গেছে। এর মধ্যে শ্রেণিকক্ষসংকট, গবেষণাগার সুবিধা না থাকা, যানবাহনসংকট অন্যতম।
শিক্ষক ও শিক্ষীর্থীরা বলছেন, একটি বিশ্ববিদ্যলয়ের উৎকর্ষ লাভের অন্যতম মানদণ্ড হচ্ছে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের গবেষণাকর্ম। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়টিতে গবেষণা কার্যক্রম খুব কম হচ্ছে। মোট ১৯৩ জন শিক্ষকের মধ্যে অনেকেই গবেষণা করছেন ব্যক্তিগত উদ্যোগে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের হয়ে ২০২০ সালে গবেষণায় আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করেছেন ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক ইলিয়াস মাহমুদ। তিনি ‘পিট ল্যাট্রিন বা আধা পাকা টয়লেট থেকে ভূগর্ভস্থ পানিদূষণ কীভাবে কমানো যায়, তা নিয়ে গবেষণা করেন। তাঁর প্রবন্ধ আমেরিকান কেমিক্যাল সোসাইটি (এসিএস) থেকে প্রকাশিত গবেষণা পত্রিকা ‘এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি’-তে ২০১৯ সালে প্রকাশিত হয়। ওই গবেষণাকর্মটি যুক্তরাজ্যভিত্তিক একাডেমিক ও প্রযুক্তিগত গবেষণা প্রকাশনা সংস্থা ‘নেচার’ পরিচালিত ‘নেচার ইনডেক্স ২০২০’-এ স্থান পায়। ৮২টি গবেষণাপত্রের মধ্যে ওই গবেষণাপত্র সেরা বিবেচ্য হয়।
একইভাবে ২০২১ সালে বায়ো মেমব্রেন নিয়ে গবেষণা করে আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে বেস্ট পোস্টার অ্যাওয়ার্ড জেতে বরিশাল বিভাগের গবেষক দল। নেতৃত্বে ছিলেন পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক খোরশেদ আলম। তিনি মনে করেন, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে গবেষণাকর্ম। কলেজে শুধু তাত্ত্বিক বিষয়ের পড়াশোনা হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণাকে মুখ্য ধরা হয়। কিন্তু তাঁদের বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনো আন্তর্জাতিক মানের গবেষণাগার গড়ে ওঠেনি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে চারজন শিক্ষক বলেন, এক যুগ হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা কার্যক্রমে কোনো গতি আনা যায়নি। গবেষণা খাতে বরাদ্দও সীমিত। আর সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো শিক্ষকেরা নিজেদের উদ্যোগে গবেষণাকাজে অংশ নিলেও শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে এটা একেবারেই অনুপস্থিত। শিক্ষার্থীদের গবেষণাকাজে সম্পৃক্ত না করা গেলে শিক্ষার মান বৃদ্ধির করার উপায় নেই। গবেষণা উপযোগী ল্যাব, সমৃদ্ধ লাইব্রেরি, বাজেট, দক্ষ শিক্ষক সবকিছুতেই সংকট রয়ে গেছে।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের সঙ্গে সক্রিয় ছিলেন সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) বরিশাল জেলা কমিটির সভাপতি অধ্যাপক শাহ সাজেদা। তিনি বলেন, ‘আন্দোলন করে একটি পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় পেয়েছি ঠিকই, কিন্তু ১১ বছরে আমরা কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারিনি। আমাদের অনেক রিসোর্স আছে। আমাদের প্রত্যাশা ছিল আমাদের শিক্ষার্থীরা এখানে পড়াশোনার পাশাপাশি নানা বিষয়ে গবেষণা করবে, নতুন নতুন বিষয় উদ্ভাবন করবে। দেশ-বিদেশের মানসম্মত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে তাঁদের একটি নিবিড় নেটওয়ার্ক তৈরি হবে। এর মাধ্যমে জ্ঞান-বিজ্ঞান, তথ্যপ্রযুক্তি, উদ্ভাবন আদান–প্রদানের মাধ্যমে শিক্ষার গুণগত মান আসবে। সেটা আমরা ততটা অর্জন করতে পারিনি।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক উন্নয়ন ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে উপাচার্য মো. ছাদেকুল আরেফিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘শিক্ষার গুণগত মান, পরিবেশ উন্নয়ন ও গবেষণার পরিধি সম্প্রসারণের লক্ষ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য একটি সমন্বিত কর্মকৌশল প্রয়োজন। কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে বৈশ্বিক নানামুখী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে টেকসই উন্নয়নে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন, চতুর্থ শিল্পবিপ্লব উপযোগী বিশ্ববিদ্যালয় বিনির্মাণ ও দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তোলার উদ্দেশ্য নিয়ে আমরা এগিয়ে চলছি। আশা করি, অচিরেই বিশ্ববিদ্যালয়টি শিক্ষা ও গবেষণার বিস্তার, মুক্তচিন্তার উন্মেষ ও বিকাশ এবং সৃজনশীল কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে প্রযুক্তিনির্ভর দিগন্ত উন্মোচনকারী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে।’