প্রশাসন আর মানুষের মধ্যে লুকোচুরি

রাজবাড়ীর দৌলতদিয়া ঘাটে মোটরসাইকেল নিয়ে ফেরিতে ওঠার চেষ্টা করছেন লোকজন। একপর্যায়ে তাঁদের ফিরিয়ে দেওয়া হয়। মঙ্গলবার দুপুরে।
ছবি: প্রথম আলো

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বাধা উপেক্ষা করে বৈরী আবহাওয়ার মধ্যেও রাজধানীর দিকে ছুটছেন দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের লোকজন। একইভাবে রাজধানী ছেড়ে আসা অনেকে দক্ষিণাঞ্চলে ছুটে চলেছেন। এ রকম উভয় দিক থেকে ছুটে চলা মানুষের ভিড় অব্যাহত রয়েছে রাজবাড়ীর দৌলতদিয়া ফেরিঘাটে। অথচ করোনার সংক্রমণ রোধে সরকারিভাবে আগামী ৫ আগস্ট পর্যন্ত কঠোর বিধিনিষেধ চলছে।

মঙ্গলবার সকাল থেকেই সেনাবাহিনী, পুলিশ, আনসার সদস্যরা দৌলতদিয়া ঘাটসহ উপজেলার গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অবস্থান নেন। এ সময় নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন গোয়ালন্দের সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. রফিকুল ইসলাম। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা এক ঘাটে অবস্থান নিলে আগত যাত্রীরা আরেক ঘাট দিয়ে ফেরিতে নদী পাড়ি দেন। এক ঘাট থেকে আরেক ঘাটে চলে দৌড়ঝাঁপ। এভাবে প্রশাসন এবং মানুষের মধ্যে যেন লুকোচুরির খেলা চলতে থাকে।

দুপুর ১২টার দিকে দৌলতদিয়ার ৫ নম্বর ফেরিঘাটে এসে ভিড়ে রো রো ফেরি ভাষাশহীদ বরকত। ফেরি থেকে যানবাহনের সঙ্গে যাত্রী নামার পরই দক্ষিণাঞ্চল থেকে আসা প্রায় ২০০ যাত্রী এবং বেশ কিছু মোটরসাইকেল উঠে পড়ে। এ সময় বাধা হয়ে দাঁড়ান আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। যাত্রীদের পাশাপাশি তাঁরা নামিয়ে দেন কয়েকটি মোটরসাইকেল।

মাগুরা সদর উপজেলার জহিরুল ইসলাম ঢাকার একটি ইনস্যুরেন্স কোম্পানিতে চাকরি করেন। ঈদের আগে গ্রামের বাড়িতে যান। সোমবার অফিসে যোগদানের কথা ছিল। পারিবারিক ঝামেলার কারণে যেতে পারেনি বলে মঙ্গলবার সকালে নিজ মোটরসাইকেল নিয়ে ঢাকার উদ্দেশে রওনা করেন। কিন্তু ফেরিতে উঠার পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা তাঁকে নামিয়ে দেন।

জহিরুল ইসলাম বলেন, ইনস্যুরেন্স কোম্পানির চাকরির কোনো ভরসা নেই। ফোন দিয়ে সোমবার সকালে জরুরি কাজে অফিসে যেতে বলেছিল। যেতে না পারায় মঙ্গলবার সকালে রওনা করি। ফেরিতে ওঠার পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা নামিয়ে দেন। বোঝানোর চেষ্টা করে লাভ হলো না। আরও ৭-৮ জন মোটরসাইকেল আরোহীকে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে।

ফরিদপুর মধুখালী থেকে মোটরসাইকেলে দৌলতদিয়া আসেন আবদুল্লাহ মামুনসহ দুজন। তাঁদেরও ফেরি থেকে নামিয়ে দেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। বৈরী আবহাওয়ার মধ্যে তাঁরা ঢাকায় যাচ্ছিলেন। দুপুরে দৌলতদিয়ার ৫ নম্বর ফেরিঘাটে আলাপকালে আবদুল্লাহ মামুন বলেন, ‘আমরা ঢাকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করি। ২৭ দিন অফিস বন্ধ ছিল। এখন অফিসে যেতে বলেছে। কীভাবে যাব, কোনো জবাব নেই। না গেলে হয়তো চাকরি থাকবে না। তাই সকালে বৃষ্টির মধ্যেই রওনা হয়েছি। ফেরিতে উঠার পরই আমাদের নামিয়ে দিল। অথচ একটু দেখেন, অনেকেই চলে যাচ্ছেন। এমনকি অন্য ঘাট দিয়েই সবাই নদী পাড়ি দিচ্ছেন।’

৫ নম্বর ঘাটে যখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কড়াকড়ি, ঠিক তখন বিপরীত চিত্র ছিল ৬ নম্বর ঘাটে। ছোট ফেরি ভেড়ামাত্র বেশ কিছু যাত্রী, কয়েকটি মোটরসাইকেল দ্রুত এতে উঠে পড়ে। কিছুক্ষণের মধ্যে কিছু যানবাহনের সঙ্গে প্রায় ২০০ জন যাত্রী নিয়ে ফেরিটি ঘাট ছেড়ে যায়।

এদিকে দক্ষিণাঞ্চল থেকে মাহিন্দ্র, ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা, মোটরসাইকেলে করে লোকজন দৌলতদিয়া ঘাটে আসছেন। মোটরসাইকেলে তিনজন, মাহিন্দ্র বা অটোরিকশাবোঝাই করে আসছেন তাঁরা। যাত্রীদের ভাড়ার বিষয় জানতে চাইলে অনেকে কথা বলতে রাজি হননি। আবার কয়েকজন জানান, নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে দ্বিগুণ, তিন গুণ বেশি ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। আবার কোনো কোনো যাত্রীর যুক্তি, ‘আমাদের তো যেতেই হবে, ভাড়া যতই হোক।’ অনেকে প্রাইভেট কার, মাইক্রোবাস ভাড়া করে যাচ্ছেন। এ ছাড়া ফেরিঘাট এলাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কঠোর অবস্থান নিতে দেখা যায়।

বিআইডব্লিউটিসি দৌলতদিয়া কার্যালয়ের সহকারী ব্যবস্থাপক খোরশেদ আলম বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চেকপোস্ট পার হয়ে যাঁরা ঘাটে আসতে পারছেন, তাঁরা ফেরিতে নদী পাড়ি দেওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন। তবে আমাদের পক্ষ থেকে সরাসরি বাধা দেওয়ার সুযোগ নেই। এমন পরিস্থিতে ছোট-বড় মিলে মোট ৭টি ফেরি চালু রাখা হয়েছে।’

গোয়ালন্দ ঘাট থানার ওসি মোহাম্মদ আবদুল্লাহ আল তায়াবীর বলেন, ‘ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের গোয়ালন্দ জমিদার ব্রিজ, গোয়ালন্দ বাজার বাসস্ট্যান্ড এবং দৌলতদিয়া ফেরিঘাট এলাকায় সকাল থেকে পুলিশ অবস্থান নেয়। এখানে বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার মানুষ জরুরি প্রয়োজনে ছুটছে। এরপরও আমরা তাদের যাচাই-বাছাই করার চেষ্টা করছি।’

ভ্রাম্যমাণ আদালতের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘সকাল ১০টা থেকে বেলা দেড়টা পর্যন্ত ফেরিঘাট এলাকায় সেনাবাহিনী, পুলিশ এবং আনসার সদস্যদের নিয়ে অবস্থান নিয়েছিলাম। একটি ঘাটে ফেরি থেকে মোটরসাইকেল, যাত্রী নামিয়ে দিলে আরেক ঘাট দিয়ে অন্য যাত্রীরা ঠিকই পার হয়ে যাচ্ছে। এভাবে আরেক ঘাট দিয়ে যাত্রীরা ঠিকই পার হয়ে যায়। কত দিক থেকে মানুষ আটকানো যায়? মানুষ যদি নিজ থেকে সচেতন না হয়, এ ক্ষেত্রে আমরা কতটুকু কী করতে পারি?’