ফাঁকা সমুদ্রসৈকত, মানবেতর জীবন

পটুয়াখালীর কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকতে পর্যটকদের ছবি তোলার কাজ করেন এই তিন আলোকচিত্রী। এখন পর্যটক না থাকায় অলস সময় কাটাচ্ছেন তাঁরা।
ছবি: প্রথম আলো

সাগরকন্যাখ্যাত পর্যটন কেন্দ্র পটুয়াখালীর কুয়াকাটার বিশাল সৈকতে পর্যটকদের পদচারণ নেই। সৈকতের বিভিন্ন স্থান এখন শুধুই নিস্তব্ধতা। করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে বিধিনিষেধ চলার কারণে এখানে আর পর্যটকদের আনাগোনা নেই। এতে হোটেল-রেস্তোরাঁ ও ছবি তোলার কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিদের আয়রোজগার বন্ধ হয়ে গেছে।

প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি পর্যটন কেন্দ্র কুয়াকাটা। এখানে একই স্থান থেকে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত উপভোগ করা যায় বলে দেশ-বিদেশের মানুষ এখানে ছুটে আসেন। কঠোর বিধিনিষেধ শেষে বৃহস্পতিবার থেকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে সব ধরনের  যানবাহন, গণপরিবহন চলাচল শুরু হয়েছে। তবে পর্যটন কেন্দ্র কুয়াকাটা বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা যায়, বিশাল সৈকতে কেউ নেই। পর্যটকদের আনন্দঘন মুহূর্তগুলো যাঁরা ছবি তুলে ধরে রাখতেন, সেই আলোকচিত্রীরাও এখন বেকার। মলিন মুখে সৈকতে দাঁড়িয়ে সময় পার করছেন তাঁরা। ‘কিটকট’ হিসেবে পরিচিত যে চেয়ার ছাতার নিচে বসে পর্যটকেরা সাগরের উত্তাল ঢেউ ও সৌন্দর্য উপভোগ করতেন, সেগুলো এখন স্তূপ করে রাখা হয়েছে।

কুয়াকাটার পাঞ্জুপাড়া এলাকার বাসিন্দা নুর হোসেন খলিফা (৩৫)। ২০টি চেয়ার ছাতার মালিক  তিনি। তাঁর কর্মচারী আছেন তিনজন। বিধিনিষেধের প্রভাবে সংসারের কষ্টের কথা তুলে নুর হোসেন বলেন, কর্মচারীরা মাসিক ৫ হাজার টাকা থেকে ১২ হাজার টাকা মজুরিতে চাকরি করতেন। সব খরচ পরিশোধ করে মাসে তাঁর লাভ থাকত ২৫ হাজার টাকা। এখন পর্যটক নেই, ব্যবসাও বন্ধ, কর্মচারীদের টাকা দেওয়া দূরের কথা, নিজের সংসার চালাতেও হিমশিম খেতে হচ্ছে। এর ওপর সামনে কোরবানির ঈদ। এ পরিস্থিতিতে কীভাবে ঈদ উদ্‌যাপন করবেন, তা তিনি বুঝতে পারছেন না।

কুয়াকাটায় মোহাম্মদ বেল্লাল (৪৫) বলেন, ‘কুয়াকাটার ১৮ জন ব্যবসায়ী চেয়ার ছাতার ব্যবসা পরিচালনা করে আসছেন। এখানে চেয়ার ছাতা রয়েছে ২২০টি। এ ব্যবসা পরিচালনার জন্য কর্মচারী আছেন অন্তত ৬০ জন। করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে বিধিনিষেধের কারণে ব্যবসা বন্ধ। ফলে সৈকতে বালুর মধ্যে পড়ে নষ্ট হচ্ছে চেয়ার ছাতাগুলো। ব্যবসা বন্ধ থাকা আমরা ও আমাদের কর্মচারীরা মানবেতর জীবন যাপন করছি।’

পটুয়াখালীর কুয়াকাটার সমুদ্র সৈকতে স্তূপ করে রাখা চেয়ার ছাতা। সম্প্রতি তোলা ছবি।
প্রথম আলো

এদিকে সৈকতে গিয়ে দেখা যায়, কয়েকজন হলুদ গেঞ্জি পরা লোক দাঁড়িয়ে আছেন। এঁদের একজন মোজাম্মেল হোসেন (৩৫), বাড়ি কুয়াকাটায়। তিনি বলেন, এখানে বেড়াতে আসা পর্যটকদের কাছে তাঁরা ‘ফটোগ্রাফার’ হিসেবে পরিচিত। সকাল থেকে সন্ধার পরও তাঁরা সৈকতে পর্যটকদের পেছনে ঘোরেন। বেড়াতে এসে আনন্দঘন মুহূর্তের ছবি তুলে পর্যটকদের দেওয়াই এঁদের কাজ। স্থানীয় বেকার যুবকেরা এই পেশায় চলে এসেছেন।

মোজাম্মেল আট বছর ধরে কুয়াকাটায় ভ্রমণে আসা পর্যটকদের ছবি তুলছেন। গরিব ঘরের সন্তান তিনি, আগে কুয়াকাটায় ভ্যান চালাতেন। একসময় ক্যামেরা হাতে নেন তিনি। করোনার কারণে চলমান বিধিনিষেধের প্রভাবে সংসারের কষ্টের কথা তুলে ধরেছেন।

মোজাম্মেল হোসেন জানান, সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পর্যটকদের ছবি তুলে দেওয়ার জন্য পিছু ছুটেছেন। অনেকে ভালোভাবে নিয়েছেন আবার অনেকে বিরক্তও হয়েছেন। তবে পেটের তাগিদে তিনি এই পেশায় এসেছেন। পর্যটকদের ছবি তুলে তাঁরা প্রতিদিন ৩০০ টাকা থেকে ৫০০ টাকা আয় করতেন। কিন্তু এখন পর্যটক না আসায় তাঁদের কোনো আয় নেই।

কুয়াকাটার আরেক আলোকচিত্রী আলো খলিফা বলেন, তাঁর আয়ের উৎস সৈকতে বেড়াতে আসা পর্যটকদের ছবি তুলে দেওয়া। কিন্তু পর্যটক না থাকায় ছবি তোলা বন্ধ। দিনমজুরির কাজও নেই। মা–বাবা, স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে পাঁচ সদস্যের পরিবার চালাতে তাঁর খুব কষ্ট হচ্ছে।  

এ বিষয়ে কুয়াকাটা পৌরসভার মেয়র আনোয়ার হাওলাদার বলেন, ‘আমরা পৌরসভা থেকে যতটুকু সম্ভব এই ব্যবসার সঙ্গে জড়িতদের সহায়তা দেওয়ার ব্যবস্থা করব। এ ছাড়া প্রশাসনের পক্ষ থেকেও তাঁরা যাতে সহায়তা পেতে পারেন, সে জন্য তাঁদের তালিকা পাঠানো হবে।’