>করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে আমাদের জীবনের বাস্তবতা। দেশ–বিদেশের পাঠকেরা এখানে লিখছেন তাঁদের এ সময়ের আনন্দ–বেদনাভরা দিনযাপনের মানবিক কাহিনি। আপনিও লিখুন। পাঠকের আরও লেখা দেখুন প্রথম আলো অনলাইনে। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]
হাসপাতালে যাওয়ার আগে যতক্ষণ ধরে রেডি হই, সে পাশে ঘুরঘুর করে বিরতিহীন দোয়া পড়তে থাকে। তাকিয়ে থাকে চোখে রাজ্যের শঙ্কা নিয়ে। অথচ করোনাকালের আগে বেরিয়ে যাওয়ার সময় শত ডেকেও তাকে পাওয়া যেত না। সংসারে তার কত যে ব্যস্ততা! সাজানো জিনিস এলোমেলো হয়েছে বলে ছেলেমেয়ের সঙ্গে চেঁচামেচি। গৃহকর্মীদের ভ্রম সংশোধন। আমার দিকে ফিরে তাকানোর ফুরসত কই!
অথচ এখন যেন তার কাজের তালিকা শূন্য। করোনার কারণে ঘণ্টাখানেক ধরে আমি প্রায় চৌদ্দটা পোশাক পরে রেডি হই। সে শুধু মন খারাপ করে নীরবে দোয়া পড়ে। অথচ একটা সময় সবকিছুর ওপর কী তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ছিল তার। কী পরছি, প্যান্টের সঙ্গে শার্ট ম্যাচিং হলো কি না, একই কাপড় বারবার পরছি কি না—এই সব।
স্বাধীনতা পেয়ে আমি দোমড়ানো–মোচড়ানো শার্ট–প্যান্ট পরে ফেললাম বেল্ট ছাড়াই। এরপর সার্জিক্যাল মাস্ক আর টুপি। আঠা দিয়ে মাস্কটির ওপরের পাড় নাক আর গালের সঙ্গে শক্ত করে আটকে দিলাম যাতে কোনো ফাঁকফোকর না থাকে। দুহাতে গ্লাভস পরে আয়নায় দেখে এন-নাইন্টি ফাইভ মাস্ক পরি। এন-নাইন্টি ফাইভের ওপর পরি আরেকটা সার্জিক্যাল মাস্ক। এরপর বড় চশমা। তারপর আগের টুপির ওপর সার্জিক্যাল টুপি নিয়ে দিয়ে কান–কপাল ঢেকে দিই। এবার পিপিই পরার পালা। পিপিইর পর শু–কাভারসহ জুতা পরার পরে আবার আরেকটা গ্লাভস পরি। এবার চশমার ওপর দিয়ে গগলস, তার ওপরে ফেসশিল্ড। আর প্রতিটি জিনিস পরার আগে একবার করে হেক্সিসলে হাত ভিজিয়ে নিই।
এবার আমি বেরোনোর জন্য প্রস্তুত। কিন্তু ততক্ষণে ঘেমে–নেয়ে একসা। কপালের ঘাম চুইয়ে চোখের কোনায় পড়লে চরম বিরক্তি লাগে। কারণ, না পারি মুছতে, না পারি সইতে। গ্রামে রোদে–ঘামেই বড় হয়েছি। বড় হয়ে সার্জিক্যাল গাউন পরে ঘামতে ঘামতে অস্ত্রোপচার করেছি। কারণ, এ এক অদ্ভুত ব্যাপার যে ওটির এসিগুলো প্রায়ই অসুস্থ থাকে।
ঘেমেনেয়ে নভোচারীর মতো পা বাড়াতেই সে পথ আগলে দাঁড়ায়। পায়ের পাতায় ভর দিয়ে উঁচু হয়ে দুহাত দিয়ে আমার মাথাটা নামিয়ে আনে। দোয়া–দরুদ পড়ে মাথায় তিনবার ফুঁ দিয়ে বলে, ‘আল্লাহ্র নাম নিতে নিতে যাবে। আয়াতুল কুরসি পড়তে থাকবে মনে মনে।’ লিফটের দরজা বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকে দরজায়। তারুণ্যে মা এভাবে দাঁড়িয়ে থাকত। এখন মা নেই। সে দাঁড়িয়ে আছে। আমার অশ্রু এসে মিশে যায় গগলসের আড়ালে ঘামের সঙ্গে। মোছার যে উপায় নেই।
এ গল্প তো আমার একার নয়, হাসপাতালে কর্মরত সব স্বাস্থ্যকর্মীর। কারও মা, কারও স্ত্রী, কারও বোন এসে একইভাবে দোয়া পড়ে প্রিয়জনদের সঁপে দিচ্ছেন সৃষ্টিকর্তার হাতে। প্রতিটি দিন, প্রতিটি রাত তাঁদের কাটছে উৎকণ্ঠায়।
হাসপাতালের পরিচালক ফোনে বললেন, ‘স্যার, আপনার কানের পাশ দিয়ে তো গুলি চলছে। আপনার সামনে বসে থাকা অ্যাটেনডেন্ট দীপেন আর অপারেশনের সময় পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সহকারী রেজিস্ট্রার ডা. জেরিনের করোনা হয়েছে।’ বললাম, ‘মহান আল্লাহ ভরসা। তাঁর ভালোবাসা পাওয়ার আশায় চোখের জল আর বুকের ভেতরের ভয় আমরা জয় করেছি।’
ভালোবাসাই জীবন। পীড়িত মানুষকে ভালোবেসে ঘরের মানুষের ভালোবাসার বাঁধন উপেক্ষা করেছি আমরা। পলিথিনে মোড়ানো সেলফোনটা হাতে নিয়ে ফোন করলাম ঘরের মানুষটিকে। কয়েকবার রিং বেজে থেমে গেল ফোন। জানি, এ সময় সে ফোন ধরবে না। আমি না ফেরা পর্যন্ত বসে থাকবে জায়নামাজে।
সোহরাব হোসেন, অধ্যাপক, ইউরোলজি বিভাগ, ঢাকা সেন্ট্রাল ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ